সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৯১-১০০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ৯১
________
অনুবাদ:
৯১ঃ এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহর নাযিলকৃতের (কিতাব) উপর ঈমান আনো (১৫৭), তখন বলে, ‘যা আমাদের উপর নাযিল হয়েছে, আমরা তার উপর ঈমান রাখি (১৫৮);’ এবং বাকীগুলোকে তারা অস্বীকার করে; অথচ তা সত্য, তাদের নিকট যা আছে তার সত্যায়ন করে (১৫৯)। (হে হাবীব!) আপনি বলে দিন, ‘অতঃপর তোমরা পূর্ববর্তী নাবীগণকে কেন শহীদ করেছো, যদি তোমাদের আপন কিতাবের উপর ঈমান থাকতো (১৬০)?
________
টীকা-১৫৭ঃ এর দ্বারা ক্বুরআন পাক এবং ঐসব কিতাব ও সহীফাগুলোকে বুঝায়, যেগুলো আল্লাহ্ تَعَالٰی নাযিল করেছেন। অর্থাৎ এ সবের উপর ঈমান আনো।
টীকা-১৫৮ঃ এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য তাওরীত।
টীকা-১৫৯ঃ অর্থাৎ তাওরীতের উপর ঈমান আনার দাবী ভিত্তিহীন; যেহেতু ক্বুরআন পাক- যা তাওরীতের সত্যায়নকারী, এর অস্বীকার করা তাওরীতেরই অস্বীকারে গণ্য হলো।
টীকা-১৬০ঃ এতেও তাদেরকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে, যদি তারা তাওরীতের উপর প্রকৃত ঈমান রাখতো, তবে নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) কে কখনো শহীদ করতো না।
আয়াত নং- ৯২
________
অনুবাদ:
৯২ঃ এবং নিশ্চয় তোমাদের নিকট মূসা স্পষ্ট নিদর্শনসমুহ নিয়ে তাশরীফ এনেছেন। অতঃপর, তোমরা এর পরে (১৬১) গো-বাছুরেকে উপাস্য করে নিয়েছো এবং তোমরা অত্যাচারী ছিলে (১৬২)
________
টীকা-১৬১ঃ অর্থাৎ হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) ‘তূর’ পাহাড়ে তাশরীফ নিয়ে যাবার পর।
টীকা-১৬২ঃ এতেও তাদেরকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে, তাদের মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর শরীয়তকে মান্য করার দাবী মিথ্যা। ‘যদি তোমরা মান্য করতে, তবে হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর عصا ‘আসা’(লাঠি), یدبیضا ‘ইয়াদে বায়দা’ (শুভ্রহস্ত মুবারক) (* হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) তাঁর নাবূয়্যাতের প্রমাণ তথা মু’জিযাস্বরূপ তাঁর হস্তকে যখন তাঁর বগলে রাখতেন, কিছুক্ষণ পর বের করলে তা পূর্ণ চন্দ্রের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে ঝলমল করতো এবং চমকিত হতো। এ জন্য তাঁর হস্ত মুবারককে ‘ইয়াদে বায়দা’ (یدبیضا) বা ‘শুভ্রহস্ত’ বলা হতো।) ইত্যাদি স্পষ্ট প্রমাণাদি প্রত্যক্ষ করার পর গো-বাছুরের পূজা করতে না।’
আয়াত নং- ৯৩
________
অনুবাদ:
৯৩ঃ এবং (স্মরণ করো) যখন আমি তোমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছি (১৬৩) এবং ‘তূর পাহাড়’কে তোমাদের মাথার উপর উত্তোলন করেছিলাম। ‘গ্রহণ করো যা আমি তোমাদেরকে দিচ্ছি, দৃঢ়ভাবে এবং শুনো!’ (তারা) বললো, ‘আমরা শ্রবণ করেছি ও অমান্য করেছি।’ আর তাদের হৃদয়গুলোতে গো-বাছুর সিঞ্চিত হয়েছিলো তাদের কুফরের কারণে। (হে হাবীব!) আপনি বলে দিন, ‘তোমাদেরকে তোমাদের (এ) ঈমান কী নিকৃষ্ট নির্দেশ দিচ্ছে, যদি (তোমরা) ঈমান রাখো (১৬৪)!’
________
টীকা-১৬৩ঃ তাওরীতের আহকাম মোতাবেক আমল করার
টীকা-১৬৪ঃ এতেও তাদের ঈমানের দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করা হয়েছে।
আয়াত নং- ৯৪
________
অনুবাদ:
৯৪ঃ (হে হাবীব!) আপনি বলে দিন, ‘যদি পরকালীন নিবাস আল্লাহর নিকট শুধু তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট হয়, না অন্য কারো জন্য, তবে তো ভালো, মৃত্যু কামনা করো, যদি সত্যবাদী হও (১৬৫)!
________
টীকা-১৬৫ঃ ইহুদীদের ভ্রান্ত দাবীগুলোর মধ্যে একটা দাবী ছিলো- ‘জান্নাত শুধু তাদেরই জন্য’। এর খন্ডন এভাবে করা হচ্ছে যে, ‘যদি তোমাদের ধারণায় জান্নাত তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট হয় এবং পরকালের দিক থেকে তোমরা নিশ্চিন্ত হও- আমলের কোন প্রয়োজন না হয়, তবে বেহেশতী নি‘মাতগুলোর মুকাবিলায় পার্থিব মুসিবতগুলোর যন্ত্রনা কেন বরদাশত করছো? মৃত্যু কামনা করো। তা’তো তোমাদের দাবীর ভিত্তিতে শান্তিরই কারণ। যদি তোমরা মৃত্যুর কামনা না করো, তবে তা তোমাদের মিথ্যুক হবার প্রমাণ হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- যদি তারা মৃত্যু কামনা করতে, তবে সবাই নিপাত যেতো এবং পৃথিবীর বুকে কোন ইহুদী অবশিষ্ট থাকতো না।
আয়াত নং- ৯৫
________
অনুবাদ:
৯৫ঃ এবং অবশ্যই কখনো তারা এর কামনা করবে না (১৬৬) সেই অপকর্মগুলোর কারণে, যেগুলো তারা পূর্বে করেছে (১৬৭) এবং আল্লাহ্ ভালভাবে জানেন অত্যাচারীদেরকে।
________
টীকা-১৬৬ঃ এটা অদৃশ্যের সংবাদ এবং মু’জিযা। কারণ, ইহুদীগণ অতিমাত্রায় গোঁড়ামী ও কঠোর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও মৃত্যু কামনার শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি।
টীকা-১৬৭ঃ যেমন- শেষ যমানার নাবী (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ও ক্বুরআন মাজীদের সাথে কুফর এবং তাওরীত বিকৃতি সাধন ইত্যাদি।
মাসআলাঃ মৃত্যুপ্রীতি এবং প্রতিপালকের সাক্ষাতের প্রবল আগ্রহ মাক্ববূল বান্দাদেরই তরীক্বা। হযরত ওমর (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) প্রতি নামাযের পর প্রার্থনা করতেন-
اَللّٰهُمَّ ارۡزُقۡنِیۡ شَهَادَةً فِیۡ سَبِیۡلِكَ وَوَفَاةً بِبَلَدِ رَسُوۡلِك۞
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদাত এবং তোমার রসূলের শহরে ওফাত নসীব করো।” সাধারণভাবে, সমস্ত সম্মানিত সাহাবী এবং বিশেষভাবে, বদর ও উহুদ যুদ্ধের শহীদগণ আর ‘বায়‘আত-ই-রিদওয়ান’- এ অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করাকে ভালবাসতেন। হযরত সা‘আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) কাফিরদের সেনাপতি রুস্তম ইবনে ফরখযাদের নিকট যে চিঠি প্রেরণ করেছেলেন তাতে লিখেছিলেন-
اِنَّ مَعَنَا قَوۡمًَا یُّحِبُّوۡنَ الۡمَوۡتَ كَمَا یُحِبُّ الۡاَعَاجِمُ الۡخَمۡرَ۞
অর্থাৎ “আমার সাথে এমন এক জাতি রয়েছে, ‘যাঁরা মৃত্যুকে এতই ভালবাসেন, যেমন অনারবীয়রা মদকে ভালবাসে।”
এতে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিলো যে, মদের ত্রুটিপূর্ণ মাতলামীর প্রতি ভালবাসাকে দুনিয়ার প্রতি লালায়িত লোকেরাই পছন্দ করে থাকে; আর আল্লাহর প্রেমিকগণ ‘মাহ্বুবে-ই-হাক্বীক্বী’ বা প্রকৃত বন্ধুর (আল্লাহ) সাথে মিলনের উপায় মনে করে মৃত্যুকে ভালবাসে। মোটকথা, ঈমানদারগণ পরকালের প্রতি আগ্রহ পোষণ করেন এবং যদি (তাঁরা) দীর্ঘ জীবনের কামনাও করেন, তবে তাও এ জন্য যে, সৎকর্ম করার জন্য এতে আরো কিছুকাল সময় পাবেন, যাতে পরকালের জন্য সৌভাগ্যের ভান্ডার আরো বৃদ্ধি করতে পারেন। যদি বিগত জীবনে কোন গুণাহর কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে, তবে তা থেকেও তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে নেবেন।
মাসআলাঃ বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত আছে যে, পার্থিব কোন দুঃখে দুঃখিত হয়ে মৃত্যু কামনা করা উচিত নয় এবং প্রকৃতপক্ষে, পার্থিব বিপদাপদে অতিষ্ঠ হয়ে মৃত্যু কামনা করা ধৈর্য, (আল্লাহর প্রতি) সন্তুষ্টি, (আল্লাহর নিকট) আত্মসমর্পন এবং (আল্লাহর উপর) ভরসা করার পরিপন্থী এবং (শরীয়তের দৃষ্টিতে) না জায়িয।
আয়াত নং- ৯৬
________
অনুবাদ:
৯৬ঃ এবং নিঃসন্দেহে, আপনি অবশ্যই তাদেরকে এমনই পাবেন যে, তারা সব লোকের চেয়েও অধিক জীবিত থাকার একান্ত কামনা রাখে এবং মুশরিকদের মধ্যে এক (দল) এর কামনা হচ্ছে যেন হাজার বছর বেঁচে থাকে (১৬৮) এবং তার এ দীর্ঘায়ু প্রদত্ত হওয়া তাকে আযাব থেকে মুক্তি দেবে না। আর আল্লাহ্ তাদের কর্মকান্ড দেখছেন।
________
টীকা-১৬৮ঃ মুশরিক বা অংশীবাদীদের একটা দল অগ্নিপূজারী। তারা পরস্পরকে সম্মান প্রদর্শন ও সালাম প্রদানের স্থানে বলে "زه هزار سال" অর্থাৎ “হাজার বছর বেঁচে থাকো।” এর অর্থ হচ্ছে- অগ্নিপূজারী মুশরিক হাজার বছর বাঁচার কামনা রাখে। ইহুদীগণ তাদেরকেও ডিঙ্গিয়ে গেছে। জীবনের মায়া তাদের অন্তরে সর্বাধিক।
আয়াত নং- ৯৭
________
অনুবাদ:
৯৭ঃ (হে হাবীব!) আপনি বলে দিন, ‘যে কেউ জিব্রাঈলের শত্রু হয় (১৬৯), তবে সে (জিব্রাঈল) তো আপনার হৃদয়ের উপর আল্লাহর নির্দেশে এ ক্বুরআন নাযিল করেছেন, পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর প্রত্যায়নকারী হিসেবে এবং সঠিক পথ-প্রদর্শন ও সুসংবাদ (হিসেবে) মুসলমানদের জন্য (১৭০)।
________
টীকা-১৬৯ঃ শানে নুযূলঃ ইহুদী সম্প্রদায়ের আলিম আবদুল্লাহ ইবনে সূরিয়া বিশ্বকুল সরদার হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে বললো, “আপনার নিকট আসমান থেকে কোন্ ফিরিশতা আসেন?” ইরশাদ ফরমালেন, “জিব্রাঈল।” ইবনে সূরিয়া বললো, “সে আমাদের শত্রু, কঠিন শাস্তি ও ভূমিধ্বস অবতরণ করে কয়েকবার আমাদের সাথে শত্রুতা করেছে। যদি আপনার প্রতি মিকাঈল আসতো, তবে আমরা আপনার উপর ঈমান আনতাম।”
টীকা-১৭০ঃ কাজেই, ইহুদীদের শত্রুতা হযরত জিব্রাঈল عَلَیۡهِ السَّلَام) এর প্রতি নিরর্থক; এবং তাদের যদি বিচারবোধ থাকতো, তবে তারা হযরত জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) কে ভালবাসতো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতো।
কারণ, তিনি এমন কিতাব এনেছেন, যা দ্বারা তাদের কিতাবের সত্যায়ন হয়। আর ْبُشۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ (মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ) ইরশাদ করার মধ্যে ইহুদী সম্প্রদায়ের দাবীর খন্ডন করা হয়েছে যে, ‘এখন তো জিব্রাঈল(عَلَیۡهِ السَّلَام) সঠিক পথের দিশা ও সুসংবাদ নিয়ে আসছেন। তারপরও কি তোমরা শত্রুতা থেকে বিরত হবে না?’
আয়াত নং- ৯৮
________
অনুবাদ:
৯৮ঃ যে কেউ শত্রু হয় আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাদের, তাঁর রসূলগণের, জিব্রাঈলের এবং মিকাঈলের, তবে আল্লাহ কাফিরদের শত্রু। (১৭১)।
________
টীকা-১৭১ঃ এ থেকে বুঝা গেল যে, নাবীগণ ও ফিরিশতাগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) এর সাথে শত্রুতা পোষণ করা কুফর এবং আল্লাহরই গযবের কারণ। আর আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সাথে শত্রুতা আল্লাহর সাথে শত্রুতা পোষণ করার শামিল।
আয়াত নং- ৯৯
________
অনুবাদ:
৯৯ঃ এবং নিঃসন্দেহে, আমি তোমাদের প্রতি স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নাযিল করেছি (১৭২); এবং এগুলোকে অস্বীকার করবে না কিন্তু ফাসিক্ব লোকেরা।
________
টীকা-১৭২ঃ শানে নুযূলঃ এ আয়াত শরীফ ইবনে সূরিয়া ইহুদীর জবাবে নাযিল হয়েছে, যে বিশ্বকুল সরদার صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে বলেছিলো, “হে মুহাম্মদ! আপনি আমাদের নিকট এমন কোন জিনিস আনেন নি, যাকে আমরা চিনি এবং আপনার উপর কোন সুস্পষ্ট নিদর্শনও নাযিল হয়নি, যাকে আমরা অনুসরণ করতে পারি।”
আয়াত নং- ১০০
________
অনুবাদ:
১০০ঃ এবং তবে কি যখনই কেউ কোন অঙ্গীকার করে (তখনই) তাদের মধ্য থেকে একদল সেটাকে ছুঁড়ে মারে? বরং তাদের অধিকাংশেরই ঈমান নেই (১৭৩)।
________
টীকা-১৭৩ঃ শানে নুযূলঃ এ আয়াত শরীফ মালিক ইবনে সায়ফ ইহুদীর জবাবে নাযিল হয়েছে। যখন বিশ্বকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ইহুদী সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ تَعَالٰی এর সেই অঙ্গীকার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, যা তারা হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর উপর ঈমান আনার প্রসঙ্গে করেছিলো, তখন ইবনে সায়ফ অঙ্গীকারের কথাই অস্বীকার করেছিলো।
0 মন্তব্যসমূহ