সূরা আলে ইমরান : আয়াত নং- ৬১-৭০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ৬১
________
অনুবাদ:
৬১ঃ
তারপর মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লা‘নত দিই (১১৬)।’
[**অর্থাৎ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে, নিজ নিজ দাবীতে যদি মিথ্যা হয় তবে আল্লাহর অভিশম্পাত কামনা করি!]
________
টীকা-১১৬ঃ যখন রসূল করীম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم নাজরানবাসী খৃষ্টানদেরকে এ আয়াত শরীফ পাঠ করে শুনালেন এবং ‘মুবাহালাহ্’র’ দাওয়াত দিলেন, তখন তারা বলতে লাগলো, “আমরা চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ করে নিই। আগামীকাল আপনাকে জবাব দেবো।” যখন তারা একত্রিত হলো তখন তারা তাদের সর্বাপেক্ষা বড় আ’লিম ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে ‘আক্বিব’ কে বললো, “হে আ’বদুল মসীহ্! আপনার অভিমত কি?” সে বললো, “হে খৃষ্টানের দল! তোমরা চিনতে পেরেছো যে, মুহাম্মদ (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) তো অবশ্যই প্রেরিত নবী। যদি তোমরা তাঁর সাথে ‘মুবাহালাহ্’ করো, তবে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন যদি খৃষ্টবাদের উপর টিকে থাকতে চাও তবে তাঁর সাথে ‘মুবাহালাহ্’ ছাড়ো এবং ঘরে ফিরে চলো।’
এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর তারা রসূল করীম এর দরবারে হাযির হলো। অতঃপর তারা দেখতে পেলো যে, হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর কোলে তো হযরত ঈমাম হুসাইন রয়েছেন, বরকতময় হাতে ইমাম হাসানের হাত এবং হযরত ফাতিমা ও হযরত আ’লী (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمۡ) হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর পেছনে উপবিষ্ট। আর হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) তাঁদেরকে ইরশাদ ফরমাচ্ছেন, “যখন আমি দুআ’ করবো তখন তোমরা সবাই ‘আমীন’ বলবে।”
নাজরানের সবচেয়ে বড় আ’লিম (পাদ্রী) যখন এসব হযরতকে দেখলো, তখন বলতে লাগলো, “হে খৃষ্টান দল! আমি এমন কতগুলো চেহারা প্রত্যক্ষ করছি যে, যদি এসব ব্যক্তিত্ব আল্লাহর দরবারে পাহাড়কে আপন স্থান থেকে সরানোর জন্য প্রার্থনা করেন, তবে আল্লাহ্ তাআ’লা পাহাড়কে আপন জায়গা থেকে সরিয়ে দিবেন। তাঁদের সাথে ‘মুবাহালাহ্’ করোনা। ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে কোন খৃষ্টান অবশিষ্ট থাকবেনা।” এ কথা শুনে খৃষ্টানরা হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর খিদমতে আরয করলো, “মুবাহালায়তো আমাদের কারো সম্মতি নেই।”
শেষ পর্যন্ত ‘জিয্য়া’ দিতে রাজী হলো; কিন্তু ‘মুবাহালা’র জন্য প্রস্তুত হলোনা। বিশ্বকুল সরদার (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ইরশাদ করলেন, “ঐ পবিত্র সত্তার শপথ, যাঁর ক্বুদরতের হাতে আমার প্রাণ,নাজরানবাসীদের উপর আযাব নিকটস্থ হয়ে এসেছিলো। যদি তারা ‘মুবাহালাহ্’ করতো তবে তারা বানর ও শূকরের আকৃতিতে বিকৃত হয়ে যেতো এবং জঙ্গল আগুনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠতো। আর নাজরান ও সেখানে বসবাসকারী পাখী পর্যন্ত নাস্তা-নাবুদ হয়ে যেতো এবং মাত্র এক বছরের মধ্যে সমস্ত খৃষ্টান ধ্বংস হয়ে যেতো।”
আয়াত নং- ৬২
________
অনুবাদ:
৬২ঃ এটাই নিঃসন্দেহে সত্য বর্ণনা (১১৭) এবং আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই (১১৮)। আর নিশ্চয় আল্লাহ্ই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
________
টীকা-১১৭ঃ অর্থাৎ হযরত ঈসা عَلَیۡهِ السَّلَامআল্লাহর বান্দাও তাঁর রসূল। তাঁর অবস্থা সেটাই, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
টীকা-১১৮ঃ এর মধ্যে খৃষ্টানদের প্রতিও খন্ডন রয়েছে এবং সমস্ত মুশরিকদের প্রতিও।
আয়াত নং- ৬৩
_______
অনুবাদ:
৬৩ঃ অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ্ ফ্যাসাদকারীদের সম্পর্কে জানেন।
আয়াত নং- ৬৪
________
অনুবাদ:
৬৪ঃ (হে হাবীব!) আপনি বলুন! ‘হে কিতাবীরা। এমন কালিমাহ্’র প্রতি এসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই (১১৯)। (তা) এই যে, আমরা যেন ইবাদত না করি কিন্তু আল্লাহরই এবং কাউকেও তাঁর শরীক না করি (১২০) ও আমাদের মধ্যে কেউ অপরকে প্রতিপালকও না বানিয়ে নিই, আল্লাহ্ ব্যতীত (১২১)।’ অতঃপর যদি তারা না মানে, তবে বলে দিন, ‘তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলমান।’
________
টীকা-১১৯ঃ এবং ক্বুরআন, তাওরীত ও ইঞ্জীলের মধ্যে এ সম্পর্কে মতভেদ নেই।
টীকা-১২০ঃ না হযরত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) কে, না হযরত ওযায়র (عَلَیۡهِ السَّلَام) কে, না অন্য কাউকে।
টীকা-১২১ঃ যেমন ইহুদী ও খৃষ্টানরা ‘আহবার’ (ইহুদী-ওলামা) ও ‘রোহবান’ (খৃষ্টান ধর্ম-যাজকবৃন্দ) কে বানিয়ে ছিলো। তারা তাদেরকে সাজদা করতো এবং তাদের উপাসনা করতো। (জুমাল)
আয়াত নং- ৬৫
________
অনুবাদ:
৬৫ঃ হে কিতাবীরা! ইব্রাহীম সম্পর্কে কেন ঝগড়া করছো? তাওরীত ও ইঞ্জীলতো অবতীর্ণ হয়নি, কিন্তু তাঁর পরে। সুতরাং তোমাদের কি বিবেক নেই (১২২)?
________
টীকা-১২২ঃ শানে নুযূলঃ নাজরানের খৃষ্টানরা এবং ইহুদীদেরকে ‘আহবার’ (আ’লিমগণ) এর মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছিলো।
ইহুদীদের দাবী ছিলো যে, হযরত ইব্রাহীম ( عَلَیۡهِ السَّلَام) ‘ইহুদী’ ছিলেন। আর খৃষ্টানদের দাবী ছিলো যে, তিনি ‘খৃষ্টান’ ছিলেন। এ বিতর্ক প্রকট আকার ধারণ করে। তখন উভয় সম্প্রদায় বিশ্বকুল সরদার صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে ‘ফয়সালাকারী’ হিসেবে মেনে নিলো এবং হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর দরবারে ফয়সালা প্রার্থনা করলো। এরই প্রসঙ্গে এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে। আর তাওরীত ও ইঞ্জীলের আ’লিমদের নিকট তাদের পূর্ণ অজ্ঞতারই কথা প্রকাশ করে দেয়া হয় যে, তাদের মধ্যেকার প্রত্যেকের দাবী তাদের পূর্ণ অজ্ঞতারই প্রমাণ। ‘ইহুদীয়াত’ ও ‘নাসরানিয়াত’ (ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ) ‘তাওরীত’ ও ‘ইঞ্জীল’ অবতরণের পরই সৃষ্ট হয়েছে। আর হযরত মূসা ( عَلَیۡهِ الصَّلٰوةُ وَالسَّلَام) এর যমানা, যাঁর উপর ‘তাওরীত’ নাযিল হয়েছে, হযরত ইব্রাহীম ( عَلَیۡهِ الصَّلٰوةُ وَالسَّلَام) এর শত শত বছর পরের এবং হযরত ঈসা ( عَلَیۡهِ الصَّلٰوةُ وَالسَّلَام), যাঁর উপর ‘ইঞ্জীল’ নাযিল হয়েছে, যাঁর যমানা হযরত মূসা ( عَلَیۡهِ السَّلَام) এর প্রায় দু’হাজার বছর পরের ছিলো। ‘তাওরীত’ ও ‘ইঞ্জীল’ কোনটার মধ্যে তঁাকে (হযরত ইব্রাহীম عَلَیۡهِ السَّلَام) ইহুদী কিংবা খৃষ্টান বলে উলে−খ করা হয়নি। এতদসত্ত্বেও তাঁর সম্পর্কে এ দাবী অজ্ঞতা ও বোকামীর চূড়ান্ত পরিচায়ক।
আয়াত নং- ৬৬
________
অনুবাদ:
৬৬ঃ শুনছো, এ যে তোমরা (১২৩)! সেই বিষয়ে ঝগড়া করেছো, যার সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান ছিলো (১২৪)। সুতরাং সে বিষয়ে (১২৫) কেন ঝগড়া করছো, যে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞানই নেই? এবং আল্লাহ্ জানেন আর তোমরা জানোনা (১২৬)।
________
টীকা-১২৩ঃ হে কিতাবীগণ, তোমরা-
টীকা-১২৪ঃ এবং তোমাদের কিতাবাদিতে এর খবর দেয়া হয়েছিলো; অর্থাৎ শেষ যমানার নবী (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর আবির্ভাব এবং তাঁর প্রশংসা ও গুণাবলীর। যখন এসব কিছু জেনে চিনেও তোমরা হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর উপর ঈমান আনোনি এবং তোমরা এ বিষয়ে ঝগড়া করেছো।
টীকা-১২৫ঃ অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম عَلَیۡهِ الصَّلٰوةُ وَالسَّلَام কে ইহুদী কিংবা খৃষ্টান বলে।
টীকা-১২৬ঃ প্রকৃত অবস্থা এই যে,
আয়াত নং- ৬৭
________
অনুবাদ:
৬৭ঃ ইব্রাহীম না ইহুদী ছিলেন, এবং না খৃষ্টান;বরং প্রত্যেক বাতিল থেকে আলাদা,মুসলমান ছিলেন এবং অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না (১২৭)।
________
টীকা-১২৭ঃ কাজেই, না কোন ইহুদী কিংবা খৃষ্টানের পক্ষে নিজেদেরকে ধর্মের দিক দিয়ে হযরত ইব্রাহীম ( عَلَیۡهِ السَّلَام) এর প্রতি সম্পর্কিত করা সহীহ হতে পারে, না কোন মুশরিক (অংশীবাদী) এর পক্ষে। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন যে, এ‘তে ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা মুশ্রিক (অংশীবাদী)
আয়াত নং- ৬৮
________
অনুবাদ:
৬৮ঃ নিশ্চয় সমস্ত লোকের মধ্যে ইব্রাহীমের অধিকতর হকদার তারাই ছিলো, যারা তাঁর অনুসারী হয়েছিলো (১২৮) এবং এ নবী (১২৯) ও ঈমানদাররা (১৩০)। আর ঈমানদারদের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ।
________
টীকা-১২৮ঃ এবং তাঁর নবূয়্যতের যুগে তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তাঁর শরীয়ত অনুসারে কাজ করতে থাকে।
টীকা-১২৯ঃ বিশ্বকুল সরদার صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم।
টীকা-১৩০ঃ এবং তাঁর উম্মতগণ।
আয়াত নং- ৬৯
________
অনুবাদ:
৬৯ঃ কিতাবীদের একটা দল আন্তরিকভাবে এ কামনা করে যে, যে কোন প্রকারে তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে। এবং তারা নিজেরাই নিজেদেরকে পথভ্রষ্ট করে এবং তাদের অনুভূতি নেই (১৩১)।
________
টীকা-১৩১ঃ শানে নুযূলঃ এ আয়াত হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল, হযরত হুযায়ফাহ্ ইবনে ইয়ামান এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمۡ) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যাঁদেরকে ইহুদীরা তাদের ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করতো এবং ইহুদীবাদের প্রতি আহ্বান করতো। এ‘তে বলা হয়েছে যে, এটা তাদের অরণ্যে রোদন মাত্র। তারা তাঁদেরকে বিপথগামী করতে পারবে না।
আয়াত নং- ৭০
________
অনুবাদ:
৭০ঃ হে কিতাবীরা! আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কেন কুফর করছো; অথচ তোমরা নিজেরাই হলে সাক্ষী (১৩২)?
________
টীকা-১৩২ঃ এবং তোমাদের কিতাবাদিতে বিশ্বকুল সরদার صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর প্রশংসা ও গুণের কথা মওজুদ রয়েছে। আর তোমরা জানো যে, তিনি সত্য নবী এবং তাঁর দ্বীনও সত্য দ্বীন।

0 মন্তব্যসমূহ