সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ১১-২০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ১১
________
অনুবাদ:
১১ঃ তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘পৃথিবীতে বিবাদ সৃষ্টি করোনা’ (১৬) তখন তারা বলে, ‘আমরাই তো সংশোধনবাদী।
________
টীকা-১৬ঃ মাসআলা : কাফিরদের সাথে মেলামেশা, তাদের খাতিরে দ্বীনে শিথিলতা অবলম্বন করা, বাতিল পন্থীদের সাথে চাটুকারিতা, তাদের সন্তুষ্টির জন্য আপোষকারীর ভূমিকা পালন করা এবং সত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা মুনাফিক্বদেরই বৈশিষ্ট্য ও হারাম। একেই বলা হয়েছে ‘মুনাফিক্বদের বিবাদ’। আজকাল অনেক লোক এটাকে স্বভাবে পরিণত করে নিয়েছে যে, তারা যেই সভায় অংশগ্রহণ করে সে সভারই হয়ে যায়। ইসলামে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যাহির ও বাতিনের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকা বড় দূষণীয়।
আয়াত নং- ১২
_________
অনুবাদ:
১২ : শুনছো! তারাই বিবাদ সৃষ্টিকারী; কিন্তু তাদের সে অনুভূতি নেই।
আয়াত নং- ১৩
__________
অনুবাদ:
১৩ঃ এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘ঈমান আনো যেমন অপরাপর লোকেরা ঈমান এনেছে’ (১৭) তখন তারা বলে, ‘নির্বোধদের মতো কি আমরাও বিশ্বাস (ঈমান) স্থাপন করবো?’ (১৮) শুনছো! তারাই হলো নির্বোধ; কিন্তু তারা তা জানেনা (১৯)।
__________
টীকা-১৭ঃ এখানে 'اَلنَّاسِ'(অপরাপর লোকেরা) থেকে হয়ত সাহাবা কিরামেই উদ্দেশ্য অথবা মু’মিনগণ। কেননা, আল্লাহর পরিচিতি লাভ, তাঁর আনুগত্য এবং পরিণামদর্শিতা দ্বারা তাঁরাই পূর্ণ মানুষ নামে অভিহিত হবার উপযুক্ত।
মাসআলাঃ اٰمِنُوۡا کَمَاۤ اٰمَنَ (তোমরা ঈমান আনো যেমন ঈমান এনেছে.......) দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘সালেহীন’ বা নেক্কার লোকদের অনুকরণ প্রশংসনীয় কাজ ও বাঞ্ছিত।
মাসআলাঃ এ কথাও প্রমাণিত হলো যে, ‘আহলে সুন্নাত’ -এর মতাদর্শই সঠিক। কেননা, এতেই ‘সালিহীন’ বান্দাদের অনুকরণ রয়েছে।
মাসআলাঃ অন্য সব ফির্কা ‘সালিহীন’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মত ও পথ থেকে বহু দূরে। অতএব, (তারা) পথভ্রষ্ট।
মাসআ’লা: কোন কোন ইমাম এ আয়াতকে ‘যিন্দীক্ব’- এর তাওবা মাক্ববুল হবার দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। (বায়দাভী শরীফ) যিন্দীক্ব ঐ ব্যক্তিকেই বলা হয়, যে (নাবীর) নবূয়তকে স্বীকার করে এবং ইসলামের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করে; কিন্তু অন্তরে এমন আক্বীদা পোষণ করে, যা সর্বসম্মতভাবে ‘কুফর’। এরাও মুনাফিক্বদের শ্রেণীভুক্ত।
টীকা-১৮ঃ এ’তে বুঝা গেল যে, ‘সালেহীন’- কে মন্দ বলা বাতিলপন্থীদের চিরাচরিত প্রথা। আজকালকার বাতিলপন্থীরাও পূর্বেকার বুযুর্গদেরকে মন্দ বলে।
‘রাফেযী সম্প্রদায়’ (শিয়া সম্প্রদায়ের একটা উপদল।) - এর লোকেরা ‘খোলাফা-ই-রাশেদীন’ (ইসলামের চার খলিফা) সহ বহু সংখ্যক সাহাবীকে, ‘খারেজীরা’ হযরত আলী মুরতাদা ও তাঁর সহচরগণ رَضِيَ اللّٰهُ عَنۡهُمۡ কে, ‘গায়র মুক্বাল্লিদগণ’ (যারা কোন ইমামের মাযহাব অনুসরণ করেনা) ‘মুজ্তাহিদ ইমামদের‘কে (যাঁরা ক্বুরআন সুন্নাহর আলোকে শরীয়তের নীতিমালা প্রণয়ন ও আহকাম বের করতে সক্ষম।) বিশেষ করে, ইমাম আ’যম আবূ হানীফা رَحۡمَةُ اللّٰهِ عَلَيۡهِ -কে ‘ওহাবীরা’ অসংখ্য আউলিয়া কিরাম ও আল্লাহর মাক্ববুল বান্দাদেরকে, মির্যায়ীরা (নবূয়তের মিথ্যা দাবীদার মীর্যা গোলাম আহমদ কাদীয়ানীর অনুসারীরা।) পূর্ববর্তী নাবীগণকে عَلَیۡهِمُ السَّلَا পর্যন্ত, ‘ক্বুরআনীরা’ (চকড়ালী) সাহাবা কিরাম ও মুহাদ্দিসগণকে এবং ‘নেচারীরা’ সমস্ত ধর্মীয় মহাপুরুষকে মন্দ বলে থাকে আর তাঁদের প্রতি অপবাদ দেয়ার ধৃষ্টতা ও দুঃসাহস দেখায়।
এ আয়াত থেকে (আরো) বুঝা গেলো যে, এসব সম্প্রদায়ই গোমরাহীতে রয়েছে। এতে দ্বীনদার আলিমদের জন্য শান্তনা রয়েছে, যেন পথভ্রষ্টদের মন্দ বলার কারণে তাঁরা অতি দুঃখিত না হন, আর মনে করেন যেন এটা বাতিলপন্থীদের চিরাচরিত স্বভাব। (মাদারিক)
টীকা-১৯ঃ মুনাফিক্বদের এ মন্দ বলা মুসলমানদের সামনে ছিলোনা; (বরং) তাঁদেরকে তো তারা এটাই বলতো, “আমরাতো সর্বান্তঃকরণে মু’মিন আছি।”
যেমন, পরবর্তী আয়াতে রয়েছে وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قَالُوۡۤا اٰمَنَّاا (অর্থাৎ যখন তারা মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, “আমরা ঈমান এনেছি।”) তারা এ ধরণের মন্দচর্চা তাদের খাস বৈঠকগুলোতে করতো। আল্লাহ্ تَعَالٰی তাদের ঐ মুখোশ খুলে দিয়েছেন। (খাযিন)
অনুরূপভাবে, আজকালের বাতিলপন্থীরাও নিজেদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো (বাতিল-আক্বীদা) সাধারণ মুসলমানদের নিকট গোপন করে; কিন্তু আল্লাহ্ تَعَالٰی তাদের পুস্তক-পুস্তিকা এবং লেখনীর মাধ্যমে তাদের এ গোপন ভ্রান্তি প্রকাশ করে দেন। এ আয়াত দ্বারা মুসলমানদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে যেন তারা বে-দ্বীনদের প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকে, ধোকা না খায়।
আয়াত নং- ১৪
_________
অনুবাদ:
১৪ঃ এবং যখন ঈমানদারদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ আর যখন নিভৃতে তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় (২০) তখন বলে, ‘আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো এমনিতে তাদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি (২১)।
________
টীকা-২০ঃ এখানে ‘শয়তানগণ’ দ্বারা কাফিরদের ঐসব দলপতিকে বুঝানো হয়েছে, যারা পথভ্রষ্ট করার কাজে লিপ্ত থাকে- (খাযিন ও বায়দাভী)। এসব মুনাফিক্ব যখন তাদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, “আমরা তোমাদেরই সাথে রয়েছি। আর মুসলমানদের সাথে আমাদের মেলামেশা শুধু তাদেরকে প্রতারিত করা ও ঠাট্টা করার ছলেই এবং এজন্য যে, তাদের গোপন কথা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে ও তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টির সমূহ সুযোগ পাওয়া যাবে।” (খাযিন)
টীকা-২১ঃ অর্থাৎ ঈমানের প্রকাশ ঠাট্টা-তামাশার ছলে করেছিলো। এটা ইসলামকে অস্বীকার করারই নামান্তর হলো।
মাসআলাঃ নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) ও দ্বীনের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করা ‘কুফর’।
শানে নুযুলঃ এ আয়াত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই প্রমুখ মুনাফিক্বের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। একদিন তারা সাহাবা কিরামের একটা জামা‘আতকে আসতে দেখলো। তখন ইবনে উবাই আপন সাথিদেরকে বললো, ‘দেখো! আমি কি করি।” যখন তাঁরা (সাহাবীগণ) নিকটে পৌঁছলেন তখন ইবনে উবাই প্রথমে সিদ্দীক্বে আকবর رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ -এর হাত মুবারক আপন হাতে নিয়ে তাঁর প্রশংসা করলো। অতঃপর অনুরূপভাবে, হযরত ওমর ও হযরত আ’লী رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا -এর প্রশংসা করলো। হযরত আ’লী মুরতাদা رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ বললেন, “হে ইবনে উবাই! আল্লাহ্কে ভয় করো, মুনাফিক্বী থেকে বিরত হও! কেননা, মুনাফিক্বরাই হলো নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।” এর উত্তরে সে বলতে লাগলো, “এসব কথাবার্তা মুনাফিক্ব-সুলভ মনোভাব নিয়ে মোটেই বলা হয়নি। আল্লাহর শপথ! আমরা আপনাদের মতোই প্রকৃত ঈমানদার।”
যখন এ সাহাবীগণ চলে গেলেন তখন সে (ইবনে উবাই) তার সাথীদের মধ্যে স্বীয় চালবাজির উপর গর্ব করতে আরম্ভ করলো।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে। (এ‘তে এ মর্মে আলোকপাত করা হয়েছে) যে, মুনাফিক্বগণ মু’মিনদের সাথে সাক্ষাতের সময় ঈমান ও ইখ্লাস (নিষ্ঠা) প্রকাশ করে থাকে। আর তাঁদের নিকট থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের খাস বৈঠকগুলোতে তা নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-তামাশা করে।
(এ ঘটনা ইমাম সা’লাভী ও ওয়াহেদী বর্ণনা করেছেন। যদিও ইবনে হাজর ও ইমাম সুয়ূতী ‘লুবাবুন্নুক্বুল’ -এর মধ্যে এ বর্ণনাকে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন।
মাসআলাঃ এ’তে বুঝা গেল যে, সাহাবা কিরাম এবং ধর্মের ইমামগণকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা ‘কুফর’।
আয়াত নং- ১৫
_________
অনুবাদ:
১৫ঃ আল্লাহ্ তাদের সাথে ঠাট্টা করেন (২২) (যেমনি তাঁর জন্য শোভা পায়) এবং তাদেরকে অবকাশ দেন, যেন তারা তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে।
__________
টীকা-২২ঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی ঠাট্টা-তামাশা ও সমস্ত দোষ-ত্রুটি ও হীন কার্যাদি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এ আয়াতে ‘ঠাট্টা-তামাশা’ দ্বারা মুনাফিক্বদের ঠাট্টা-তামাশার শাস্তির কথাই বুঝানো হয়েছে; যাতে এ কথা ভালোরূপে হৃদয়ঙ্গম হয় যে, এ শাস্তি তাদের অপকর্মের কারণেই। (এখানে পরিণামের স্থলে কর্ম উল্লেখ করা হয়েছে। আর) এ ধরণের স্থানে পরিণতির স্থলে কর্মের উল্লেখ করা নিতান্ত অলংকার শাস্ত্রসম্মত। যেমন جَزَاءُ سَیِّئَةٍ سَیِّئَةٌ (অপকারের পরিণাম অপকারই)। এখানে পূর্ণতা হলো- এ বাক্যটাকে اَللّٰہُ یَسۡتَہۡزِئُ الایَة (অর্থাৎ পূর্বে উল্লেখিত (اِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَہۡزِءُوۡنَ) বাক্যটার উপর عطف (অব্যয় দ্বারা সম্বন্ধিত) করা হয়নি। কারণ, পূর্ববর্তী বাক্যে উল্লেখিত (استهزَء) বা ঠাট্টা-তামাশা প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। (কিন্তু এ আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে রূপকার্থে।)
আয়াত নং- ১৬
_________
অনুবাদ:
১৬ঃ তারা এমনসব লোক, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী ক্রয় করেছে (২৩)। সুতরাং তাদের এ ব্যবসা কোন লাভ আনয়ন করেনি এবং তারা ব্যবসার লাভজনক পন্থা জানতোইনা (২৪)।
________
টীকা-২৩ঃ হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহী খরিদ করার অর্থ হলো- ঈমানের পরিবর্তে কুফরই গ্রহণ করা। তা অতীব ক্ষতিকর বিষয়।
শানে নুযুলঃ এ আয়াত হয়তো ঐসব ব্যক্তি সম্পর্কে নাযিল হয়েছে; কিংবা (এ আয়াত শরীফ) ইহুদীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যারা পূর্ব থেকেই হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর উপর ঈমান রাখতো কিন্তু যখন হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর আবির্ভাব হলো, তখন তারা তাঁকে অস্বীকারকারী হয়ে বসলো। অথবা, সমস্ত কাফিরের প্রসঙ্গে (এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে); যাদেরকে আল্লাহ্ تَعَالٰی জন্মগতভাবে সঠিক বিবেক দান করেছেন, সত্যের প্রমাণাদি সমুজ্জ্বল করেছেন, হিদায়াতের পথ উম্মুক্ত করে দিয়েছেন; কিন্তু তারা সে-ই বিবেক-বিবেচনাশক্তিকে কাজে লাগায়নি,বরং পথভ্রষ্টতাকেই গ্রহণ করেছে।
মাসআলাঃ এ আয়াত দ্বারা (পারস্পারিক) লেনদেনের বৈধতা প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ ‘বেচা-কেনা’র কোন শব্দ ব্যবহার করা ব্যতিরেকেই শুধু পারস্পারিক রেযামন্দির (সম্মতি) ভিত্তিতে এক বস্তুর পরিবর্তে অন্য বস্তর লেনদেন জায়েয বা বৈধ।
টীকা-২৪ঃ কেননা, তারা যদি সঠিক নিয়ম জানতো তবে তারা আসল মূলধন (হিদায়াত) -কে হারিয়ে বসতোনা।
আয়াত নং- ১৭
________
অনুবাদ:
১৭ঃ তাদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছে; অতঃপর যখন তা দ্বারা আশেপাশে সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠলো, তখন আল্লাহ তাদের জ্যোতি অপসারণ করে নিলেন এবং তাদেরকে (এমনভাবে) অন্ধকাররাশিতে ছেড়ে দিলেন যে, তারা কিছুই দেখতে পায় না (২৫)
_______
টীকা-২৫ঃ এটা তাদেরই দৃষ্টান্ত, যাদেরকে আল্লাহ تَعَالٰی কিছু হিদায়াত প্রদান করেছেন অথবা হিদায়াত গ্রহণের ক্ষমতা দান করেছেন। অতঃপর তারা তা বিনষ্ট করেছে এবং চিরস্থায়ী সম্পদকে আহরণ করেনি। তাদের পরিণতি হচ্ছে- অনুতাপ, আফসোস এবং ভয়-ভীতি। এর মধ্যে ঐসব মুনাফিক্বও শামিল, যারা বাহ্যিকভাবে ঈমানদার বলে পরিচয় দিয়েছে; কিন্তু অন্তরে ‘কুফর; গোপন রেখে স্বীকারোক্তির আলো বিনষ্ট করে ফেলেছে। আর ঐসব ব্যক্তিও (এর মধ্যে শামিল), যারা ঈমান আনার পর ‘মুরতাদ্দ্’ হয়েছে এবং তারাও, যাদেরকে জন্মগতভাবে সুস্থ্য বিবেক দেয়া হয়েছে আর অকাট্য প্রমাণাদির আলোকরশ্মি ও সত্যকে সুস্পষ্ট করেছে; কিন্তু, তারা তা থেকে উপকার গ্রহণ করেনি; বরং গোমরাহীকেই বেছে নিয়েছে। আর যখন সত্য শুনা, গ্রহণ করা, সত্য বলা এবং সত্য পথ দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তখন তাদের কান, জিহ্বা ও চোখ সবই অকেজো।
আয়াত নং- ১৮
________
অনুবাদ:
১৮ঃ বধির, বোবা ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসার নয়।
______
আয়াত নং- ১৯
_______
অনুবাদ:
১৯ঃ কিংবা যেমন, আসমান থেকে বর্ষণরত বৃষ্টি, যাতে রয়েছে অন্ধকাররাশি, বজ্র ও বিদ্যুৎ-চমক (২৬); (তারা) নিজেদের কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে বজ্র-ধ্বনির কারণে, মৃত্যুর ভয়ে(২৭); এবং আল্লাহ্ কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করেই রয়েছেন (২৮)।
______
টীকা-২৬ঃ হিাদয়াতের পরিবর্তে গোমরাহী ক্রেতাদের এটা হলো দ্বিতীয় উপমা। বৃষ্টি যেমন জমিন জীবনের কারণ হয়, আর এর সাথে থাকে ভীতিপ্রদ ঘন অন্ধকার, ভয়ানক বজ্রপাত ও বিজলী, তেমনিভাবে ক্বুরআন ও ইসলাম অন্তরসমূহের ‘হায়াত’ বা জীবনের কারণ হয়। পক্ষান্তরে, কুফর, শির্ক ও নিফাক্ব (মুনাফিক্বি) -এর উল্লেখ অন্ধকারের সমতুল্য; যেমন অন্ধকার যাত্রীকে গন্তব্যস্থানে পৌঁছার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তেমনি কুফর এবং নিফাক্বও সত্যের দিশা লাভের পথে বাধা দেয়। আর সতর্কবানীগুলো বজ্রতুল্য এবং সুস্পষ্ট প্রমাণাদি বিজলীর সমতুল্য।
শানে নুযুলঃ দু’জন মুনাফিক্ব হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم-এর দরবার থেকে মুশরিকদের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে এমন ধরণের বৃষ্টিপাত আরম্ভ হলো যার বিবরণ আয়াতে দেয়া হয়েছে। তা‘তে ভয়ানক বজ্রপাত ও বিজলী ছিলো। যখন বজ্রপাত হতো তখন তারা নিজেদের কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দিতো, যাতে ভীষণ গর্জন কান বিদীর্ণ করে তাদেরকে মৃত্যুমুখে পতিত না করে। আর যখন বিজলী চমকিত হতো তখন তারাপথ চলতে আরম্ভ করতো। আবার যখন অন্ধকার হয়ে যেতো তখন অন্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো। (এ বিপদসঙ্কুল অবস্থায়) তারা পরস্পর বলতে লাগলো, “আল্লাহ যদি নিরাপদে ভোর আনয়ন করেন, তবে আমরা পুনরায় হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم-এর দরবারে হাযির হয়ে নিজেদের হাত তাঁরই হাতে অর্পন করবো।” অতএব তারা অনুরূপই করেছিলো এবং ইসলাম ধর্মে প্রতিষ্ঠিত রইলো। তাদের এ অবস্থাকে আল্লাহ্ تَعَالٰی ঐসব মুনাফিক্বের জন্য উদাহরণে পরিণত করেছেন, যারা হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর মজলিসে হাযির হলে নিজেদের কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দিতো, যাতে কখনো হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর নসীহত তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে, যার কারণে তারা যেন মৃত্যুমুখে পতিত হতো! আর যখন তাদের মাল দৌলত ও আওলাদ বেশী হতো এবং বিজয় ও গণীমতের সম্পদ (ধর্মীয় যুদ্ধে পরাজিত কাফিরদের সম্পদ।) অর্জিত হতো তখন বিজলীর আলোকপ্রাপ্তদের ন্যায় সম্মুখে অগ্রসর হতো এবং বলতো, “এখনতো ‘দ্বীন-ই-মুহাম্মাদী صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم সত্য।” আর যখন তাদের ধন-সম্পদ ও আওলাদ ক্ষতিগ্রস্ত হতো এবং কোন বালা-মুসিবত আসতো, তখন বৃষ্টির ঘন অন্ধকারে থমকে দাঁড়ানো লোকদের ন্যায় বলতো যে, এসব মুসীবত তো সে দ্বীনের কারণেই এসেছে এবং ইসলাম ত্যাগ করতো। (ইমাম সুয়ূতী প্রণীত ‘লুবাবুননুকূল।)
টীকা-২৭ঃ যেমন অন্ধকার রাতে কালো ঘনঘটা ছাইয়ে যায় এবং বিজলী-বজ্রের গর্জন ও চমক জঙ্গলে-ময়দানে মুসাফিরদেরকে হতভম্ব করে আর বজ্রের ভয়ানক কারণে তারা মৃত্যুভয়ে নিজেদের কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দেয়, অনুরূপভাবে, কাফিরগণও ক্বুরআন পাক শ্রবণ না করার জন্য কান বন্ধ করে রাখে। আর তাদের মনে এ আশংকাই পীড়া দেয় যে, কখনো আবার ক্বুরআনের কোন মনমুগ্ধকর বিষয় ইসলাম ও ঈমানের দিকে তাদের অন্তরকে আকৃষ্ট করে তাদের পূর্বপুরুষদের কুফরী ধর্মকে বর্জন করিয়ে বসবে কিনা ! তা তাদের নিকট মৃত্যুই সমতুল্য।
টীকা-২৮ঃ কাজেই, তাদের এ পলায়ন তাদেরকে কোনরূপ উপকৃত করতে পারেনা। কেননা,তারা কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে পারেনা।
আয়াত নং- ২০
________
অনুবাদ:
২০ঃ বিদ্যুৎ-চমক এমনি মনে হয় যেন তাদের দৃষ্টি-শক্তি কেড়ে নিয়ে যাবে (২৯)। যখনই সামান্য বিদ্যুতালোক (তাদের সম্মুখে) উদ্ভাসিত হলো তখন তাতে চলতে লাগলো (৩০) এবং যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো তখন তারা দাঁড়িয়ে রইলো।আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাদের কান ও চোখ নিয়ে যেতেন (৩১)। নিঃসন্দেহে, আল্লাহ্ সবকিছু করতে পারেন (৩২)।
________
টীকা-২৯ঃ যেমন, বিজলীর চমককে মনে হয় যে, তা দৃষ্টিশক্তিকে ছিনিয়ে নেবে, তেমনি সুস্পষ্ট দলীলাদির জ্যোতিও যেন তাদের অন্তরদৃষ্টিকে দুষ্ট করে ফেলবে।
টীকা-৩০ঃ যেভাবে, অন্ধকার রাতে এবং বৃষ্টি-বাদলের ঘন অন্ধকারে মুসাফির দিশেহারা হয়ে যায়; তখন বিজলী চমকিত হলে কিছুদূর সামনে এগিয়ে যায় আর অন্ধকার হলে আবার থমকে দাঁড়িয়ে থাকে; অনুরূপভাবে, ইসলামের বিজয়, মু’জিযাসমূহের আলোকে এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় মুনাফিক্বগণ ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে; আবার যখন কোন কষ্ট বা দুঃখ-দুর্দশা এসে পড়ে, তখন তারা কুফরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে এবং ইসলাম থেকে সরে পড়তে আরম্ভ করে। এ বিষয়কে অন্য আয়াতে এ ভাবে ইরশাদ করেছেন- اِذَا دُعُوۡٓا اِلَی اللّٰهِ وَرَسُوۡلِهٖ لِیَحۡكُمَ بَیۡنَهُمۡ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡهُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ۞ وَاِنۡ یَّكُنۡ لَّهُمُ الۡحَقُّ یَاۡتُوۡآ اِلَیۡهِ مُذۡعِنِیۡنَ۞
(অর্থাৎ যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি, তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। যদি তারা সত্য হতো, তবে এর প্রতি একান্ত বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে আসতো।) (খাযিন ও সাভী ইত্যাদি)
টীকা-৩১ঃ অর্থাৎ যদিও মুনাফিক্বদের কর্মনীতি এ ধরণের শাস্তির উপযোগী ছিলো, কিন্তু (এতদ্সত্ত্বেও) আল্লাহ تَعَالٰی তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিকে বাতিল করেননি।
মাসআলাঃ এতে বুঝা গেল যে, উপকরণের কার্যকারিতার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে-‘আল্লাহর ইচ্ছা’ । অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত শুধু উপায়-উপকরণাদী কিছুই করতে পারেনা।
মাসআলাঃ একথাও প্রতিভাত হয় যে, আল্লাহর ইচ্ছা কোন কারণ-উপকরণের মুখাপেক্ষী নয়। তিনি কারণ-উপকরণ ছাড়াই যা চান করতে পারেন।
টীকা-৩২ঃ ‘شَیۡءٌّ’ হচ্ছে- ‘যা আল্লাহ্ চান এবং যা আল্লাহর ইচ্ছাধীন হতে পারে’। সমস্ত ‘মুমকিন’ (সম্ভাবনাময় বস্তু) ( ‘সূরা ফাতিহার’ প্রথম আয়াতের টীকা-তাফসীর দ্রষ্টব্য। ) ‘شَیۡءٌّ’ -এর অন্তভুর্ক্ত। এ কারণে সেগুলো আল্লাহ্ تَعَالٰی এর ক্বুদরতের আওতাধীন। আর যা ‘মুমকিন’ নয় তা হচ্ছে- ‘ওয়াজিব’ (وَاجِبٌ) (যার অস্তিত্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আবশ্যকীয়, কারো মুখাপেক্ষী নয়।) অথবা ‘মুমতানি’ (مُمۡتَنِعٌ) বা অসম্ভব।
আল্লাহর ক্বুদরত ও ইচ্ছার সাথে এর (‘ওয়াজিব’ কিংবা ‘মুমতানি’) -এর কোন সম্পর্ক নেই। (অর্থাৎ এর শক্তি ও ইচ্ছা ‘ওয়াজিব’ এবং ‘অসম্ভব’ বিষয়াদির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়।) যেমন আল্লাহ্ تَعَالٰی এর সত্তা এবং তাঁর গুণাবলী ‘ওয়াজিব’; এ কারণে (তা) আল্লাহর সৃষ্টি বা ক্বুদরতভুক্ত (مقدور) নয়।
মাসআলাঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی এর পক্ষে মিথ্যাবলা এবং সমস্ত দোষত্রুটি ‘অসম্ভব’। এ কারণে এসব (অশোভন) জিনিসের (কার্যাদি) সাথে আল্লাহর শক্তির কোন সম্পর্ক নেই।

0 মন্তব্যসমূহ