সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ১০১-১১০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ১০১
________
অনুবাদ:
১০১ঃ এবং যখন তাদের নিকট তাশরীফ আনলেন আল্লাহর নিকট থেকে একজন রসূল (১৭৪), তাদের কিতাবগুলোর সমর্থকরূপে (১৭৫) তখন কিতাবীদের একটা দল আল্লাহর কিতাবকে তাদের পৃষ্ঠে-পেছনে নিক্ষেপ করেছে (১৭৬), যেন তারা কোন জ্ঞানই রাখেনা (১৭৭)
________
টীকা-১৭৪ঃ অর্থাৎ বিশ্বকুল সরদার হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم
টীকা-১৭৫ঃ বিশ্বকুল সরদার صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم তাওরীত ও যাবূর ইত্যাদি কিতাবের সত্যায়ন করতেন এবং স্বয়ং সেসব কিতাবেও হুযূর কারীম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর তাশরীফ আনয়নের সুসংবাদ, তাঁর গুণাবলী এবং বিভিন্ন অবস্থার বর্ণনা ছিলো। এ কারণে, হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّمএর শুভাগমন এবং তাঁর বরকতময় উপস্থিতিই সেসব কিতাবের প্রত্যায়ন করে। কাজেই, অবস্থার দাবী এ ছিলো যে, হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর শুভাগমনের উপর ভিত্তি করে আহলে কিতাবের ঈমান তাদের কিতাবগুলোর উপর আরো অধিক মজবুত হোক। কিন্তু এরই বিপরীত, তার নিজেদের কিতাবের সাথেও কুফর করেছে। মুফাসসির সুদ্দীর অভিমত হচ্ছে- যখন হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর আবির্ভাব হয়েছিলো, তখন ইহুদীগণ তাওরীতের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে তাওরীত এবং ক্বুরআনকে পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ পেয়েছিলো বিধায় তারা তাওরীতকেও ছেড়ে দিয়েছিলো।
টীকা-১৭৬ঃ অর্থাৎ ঐ কিতাবের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেনি। হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নাহ্ এর অভিমত হচ্ছে- ইহুদীগণ তাওরীতকে মূল্যবান রেশমী গিলাফে স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা খচিত ও সজ্জিত করে রেখে দিয়েছিলো; কিন্তু এর বিধি-নিষেধকে অমান্য করেছিলো।
টীকা-১৭৭ঃ এসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, ইহুদীদের চারটা দল ছিলো-
১ম দলঃ তাওরীতের উপর ঈমান এনেছিলো এবং তাঁরা এর বিধি-বিধানও মেনে নিয়েছিলো। তারা হলো- ঈমানদার কিতাবী সম্প্রদায়। তাদের সংখ্যা নগণ্য। আর আল্লাহ পাকের ইরশাদ- اَكۡثَرُهُمۡ(তাদের অধিকাংশ) এর মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
২য় দলঃ প্রকাশ্যে তাওরীতের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিলো,এর নির্দ্ধারিত সীমা লংঘন করেছিলো এবং গোঁড়ামী অবলম্বন করেছিলো। "نَبَذَ فَرِیۡقٌ مِّنۡهُمۡ” (তাদের মধ্যে একদল সেটাকে ছুঁড়ে মেরেছে) এর মধ্যেই তাদের বর্ণনা রয়েছে।
৩য় দলঃ নিজেদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা ঘোষণা তো করেনি; কিন্তু নিজেদের মূর্খতার কারণে সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেই চলছিলো, এদের কথা بَلۡ اَکۡثَرُہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ (বরং তাদের অনেকেই ঈমানদার নয়)- এর মধ্যে উল্লেখিত হয়।
৪র্থ দলঃ প্রকাশ্যভাবেতো ঐ অঙ্গীকার মান্য করতো;কিন্তু অন্তরে অন্তরে বিদ্রোহ ও গোঁড়ামী দ্বারা এর বিরোধিতা করতে লাগলো। আর বানোয়াটভাবে মূর্খ সেজে বসতো। "کَاَنَّہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ” (যেন তারা কোন জ্ঞানই রাখেনা) দ্বারা এদের সম্পর্কে জানা যায়।
আয়াত নং- ১০২
________
অনুবাদ:
১০২ঃ এবং (তারা) তারই অনুসারী হয়েছে, যা শয়তান পাঠ করতো সুলায়মানের রাজত্বকালে (১৭৮); এবং সুলায়মান কুফর করেনি (১৭৯)। হ্যাঁ, কাফির হয়েছিলো শয়তান (১৮০); (তারা) মানুষকে যাদু শিক্ষা দেয় এবং ঐ (যাদু), যা ‘বাবেল’ শহরে দু’জন ফিরিশতা- হারুত ও মারুতের উপর অবতীর্ণ হয়েছিলো। আর তারা দু’জন কাউকেও কিছু শিক্ষা দিতো না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা একথা বলে দিতোনা, ‘আমরা তো নিছক পরীক্ষা। কাজেই, নিজ ঈমান হারিয়ে বসোনা (১৮১)!’ অতঃপর (তারা) তাদের নিকট তাই শিখতো, যা বিরোধ-বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতো পুরুষ এবং তার স্ত্রীর মধ্যে। এবং তা দ্বারা কারো ক্ষতি সাধন করতে পারতো না, কিন্তু আল্লাহরই নির্দেশে (১৮২)। এবং তারা তাই শিক্ষা করে, যা তাদের ক্ষতি সাধণ করবে, উপকার করবে না এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাদের জানা আছে যে, যে ব্যক্তি এ সওদা ক্রয় করেছে পরকালে তার কোন অংশ নেই; এবং নিশ্চয় তা কতই নিকৃষ্ট বস্তু, যার বিনিময়ে তারা নিজেদের আত্মাসমূহ বিক্রি করেছে! যদি কোন রকমে তাদের জ্ঞান হতো (১৮৩)!
________
টীকা-১৭৮ঃ শানে নুযূলঃ হযরত সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর যামানায় বনী-ইস্রাঈল যাদু শিক্ষায় মগ্ন হয়েছিলো। তখন তিনি তাদেরকে তাতে বাধা দিলেন এবং (যাদুমন্ত্রের) বইগুলো তাদের নিকট থেকে বাজেয়াপ্ত করে সিংহাসনের নীচে পুঁতে ফেললেন। হযরত সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর ওফাতের পর শয়তানগণ সেসব বই-পুস্তক বের করে জনগণকে বললো, “সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) এ গুলোর জোরেই বাদশাহী করতেন।” বানী ইস্রাঈলের সৎ ব্যক্তিগণ ও ওলামা কিরাম এ কথা অস্বীকার করলেন। কিন্তু তাদের অশিক্ষিত লোকেরা যাদু বিদ্যাকে হযরত সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) এরই জ্ঞান বলে বিশ্বাস করে তা শিক্ষা করার দিকে অত্যধিক ঝুঁকে পড়লো।
নাবীগন (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) এর কিতাবাদি ছেড়ে দিলো আর হযরত সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর সমালোচনা করতে আরম্ভ করলো। তারা নাবীকুল সরদার হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর যামানা পর্যন্ত এ অবস্থায় ছিলো। আল্লাহ্ تَعَالٰی হযরত সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) কে নির্দোষ ঘোষণা করে হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর উপর এ আয়াত শরীফ নাযিল করলেন।
টীকা-১৭৯ঃ কেননা, তিনি হলেন একজন নাবী। নাবীগন (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) ‘কুফর’ থেকে সম্পূর্ণ সন্দেহাতীতভাবে ‘মা’সূম’ (বে-গুণাহ্) হন। তাঁদের প্রতি ‘যাদুর’ অপবাদ দেয়া জঘণ্য ভ্রান্তি ও ভুল। কেননা, যাদু কুফরসমূহ থেকে মুক্ত হওয়াই বিরল।
টীকা-১৮০ঃ যারা হযরত সুলায়মান (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর উপর যাদুগরীর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলো;
টীকা-১৮১ঃ অর্থাৎ যাদু শিক্ষা করে এবং তদানুযায়ী আমল করে, তাতে একান্তভাবে বিশ্বাস করে এবং সেটাকে ‘মুবাহ’ বা বৈধ জ্ঞান করে কাফির হয়োনা। এ যাদু অনুগত ও অবাধ্যের মধ্যে পার্থক্য ও পরীক্ষার জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলো। যে ব্যক্তি তা শিক্ষা করে তদানুযায়ী আমল করবে সে কাফির হয়ে যাবে- এ শর্তে যে, যদি এ যাদুর মধ্যে ঈমানের পরিপন্থী বাক্য এবং কার্যাদি থাকে। আর যে ব্যক্তি তা থেকে বেঁচে থাকে, শিখেনা, কিংবা শিক্ষা করে, কিন্তু তদনুযায়ী আমল করে না এবং এর মধ্যেকার কুফরগুলোতে বিশ্বাস করেনা, সে মু’মিন থাকবে। এটা ইমান আবুল মানসুর মাতুরীদি رَحۡمَةُ اللّٰهِ عَلَيۡهِ) এর অভিমত।
(* আহলে সুন্নাতের তাত্ত্বিক দু’ধারা। যথা- (১) মাতুরীদিয়্যাহ ও (২) আশা-‘ইরাহ। ‘মাতুরীদিয়্যাহ’ হলেন- হযরত আবুল মানসূর মাতুরীদীর অনুসারীগণ। আর ‘আশা-‘ইরাহ’ হলেন হযরত আবুল হাসান আশ্‘আরীর অনুসারীগণ। অথবা এভাবে বলা যায়- হযরত আবুল মানসূর মাতুরীদি (رَحۡمَةُ اللّٰهِ عَلَيۡهِ) আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত এর দু‘জন তাত্ত্বিক ইমামের একজন। আক্বীদার বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের লোকেরা তাঁকেই অনুসরণ করেন। অপরজন হলেন- হযরত আবুল হাসান আশ‘আরী (رَحۡمَةُ اللّٰهِ عَلَيۡهِ)। তাঁর অনুসারীদেরকে “আশা-‘ইরাহ’ বলা হয়। ইমাম শাফে‘ঈ ও তাঁর অনুসারীগণ এবং অন্যান্যরাও আক্বীদার ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করে থাকেন।)
মাসআলাঃ যে যাদু কুফর, সে ধরণের যাদুকার্য সম্পাদনকারী যদি পুরুষ হয়, তবে তাকে কতল করা যাবে।
মাসআলাঃ যে যাদু কুফর নয়, কিন্তু তা দ্বারা কারো প্রাণ বিনষ্ট করা যায়, তবে এ ধরনের যাদুগর রাহাজানিকারী বা ডাকাতদের অন্তর্ভুক্ত; চাই সে পুরুষ হোক, কিংবা স্ত্রীলোক।
মাসআলাঃ যাদুকরের তাওবা কবুল হয়। (মাদারিক)
টীকা-১৮২ঃ মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা যায় যে, প্রকৃত প্রভাব বিস্তারকারী(Real Cause) হলেন- আল্লাহ্ تَعَالٰی। আর উপকরণাদির প্রভাবও আল্লাহর ইচ্ছাধীন।
টীকা-১৮৩ঃ স্বীয় পরিণতি ও কঠিন শাস্তির!
আয়াত নং- ১০৩
________
অনুবাদ:
১০৩ঃ এবং যদি তারা ঈমান আনতো (১৮৪) এবং সাবধানতা অবলম্বন করতো, তবে আল্লাহর নিকটস্থিত সাওয়াব অত্যধিক উত্তম যদি কোন প্রকারে তাদের জ্ঞান হতো!
________
টীকা-১৮৪ঃ হযরত সৈয়্যদে কা-ইনাত হুযূর কারীম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এবং ক্বুরআন পাকের উপর,
আয়াত নং- ১০৪
________
অনুবাদ:
১০৪ঃ হে ঈমানদারগণ (১৮৫)! ‘রা-‘ইনা’ বলোনা এবং এভাবে আরয করো, ‘হুযূর, আমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি রাখুন! এবং প্রথমথেকেই মনোযোগ সহকারে শুনো (১৮৬)। আর কাফিরদের জন্য বেদনাদায়ক শাস্তি অবধারিত (১৮৭)
________
টীকা-১৮৫ঃ শানে নুযূলঃ যখন হুযূর আকরাম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم সাহাবা কিরামকে কিছু শিক্ষা-দীক্ষা দান করতেন- رٰعِنَا یَا رَسُوۡلَ اللّٰهِ (রা-‘ইনা ইয়া রাসূলাল্লাহ্)! এর অর্থ ছিলো- ‘হে আল্লাহর রসূল!
আমাদের অবস্থার প্রতি কৃপাদৃষ্টি রাখুন! অর্থাৎ আপনার প্রবিত্রতম কালাম আমাদেরকে ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ দান করুন!’ ইহুদীদের ভাষায় এ (রা-‘ইনা) কালিমাহ্টা বে-আদবীর অর্থ প্রকাশ করতো। তারা সে শব্দটা এ কুউদ্দেশ্যেই বলতে শুরু করলো।
হযরত সা‘আদ ইবনে মু‘আয (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) ইহুদীদের পরিভাষা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি একদিন তাদের মুখে এ কলেমাটা (রা-‘ইনা) শুনে বললেন, “ওহে খোদার শত্রুরা! তোদের উপর খোদার লা‘নত (অভিসম্পাত) হোক! আমি যদি এখন থেকে কারো মুখে এ কালিমাহ্টা শুনি তবে তার গর্দান উড়িয়ে দেবো।” ইহুদীরা বললো, “আমাদের উপর তো আপনি রাগান্বিত হচ্ছেন; মুসলমানরাও তো এটাই বলে থাকে।”
একথা শুনে তিনি দুঃখিত হয়ে হুযূর পাক صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর দরবারে হাযির হলেন। তখনই এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়, যার মধ্যেই رٰعِنَا (রা-‘ইনা) বলতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এরই সমার্থক শব্দاُنۡظُرۡنَا (উনযুরনা) বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা গেলো যে, “এ থেকে বুঝা গেলো যে, নাবীগণ عَلَیۡهِمُ السَّلَام এর প্রতি ইজ্জত ও সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁদের খেদমতে শিষ্টাচারমূলক কালিমাহ্ ব্যবহার করা ফরয। আর যে শব্দে বে-আদবীর লেশমাত্রও থাকে সে ধরণের শব্দ মুখে উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ।
টীকা-১৮৬ঃ এবং ‘সর্ব শরীর কর্ণ হয়ে’ শুনো; যাতে এ ধরণের আরয করার প্রয়োজন না হয়- ‘হুযূর, একটু কৃপাদৃষ্টি দিন।’ কেননা, এটাই নাবীর দরবারের আদব।
মাসআলাঃ নাবীগণের দরবারে মানুষের উপর চূড়ান্ত পর্যায়ের আদব বজায় রাখা কর্তব্য।
টীকা-১৮৭ঃ মাসআলাঃ ‘লিল্ কাফিরীন’ (কাফিরদের জন্য) আয়াতাংশের ইঙ্গিত রয়েছে যে, নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام)- এর শানে বে-আদবী করা কুফর।
আয়াত নং- ১০৫
________
অনুবাদ:
১০৫ঃ তারাই, যারা কাফির, কিতাবী কিংবা মুশরিক (১৮৮), তারা চায়না যে, তোমাদের উপর কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হোক তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে (১৮৯) এবং আল্লাহ্ স্বীয় রহমত দ্বারা বিশেষভাবে মনোনীত করেন যাকে চান; এবং আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহশীল।
________
টীকা-১৮৮ঃ শানে নুযূলঃ ইহুদীদের একটি দল মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব ও হিতকামিতা প্রকাশ করে আসছিলো। তাদেরকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে যে, কাফিরগণ তাদের হিতাকাঙ্খী হবার দাবীতে মিথ্যুক। (জুমাল)
টীকা-১৮৯ঃ অর্থাৎ কিতাবী সম্প্রদায়ের কাফিরগণ ও মুশরিকদল উভয়ই মুসলমানদের সাথে শত্রুতা পোষণ করতো। আর এ বিদ্বেষে জ্বলতো যে, ‘তাদের (মুসলমানগণ) নাবী হযরত মুহাম্মদ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে নাবূয়্যাত ও ওহী প্রদান করা হয়েছে আর মুসলমানদেরও এ বৃহত্তম নি‘আমত অর্জিত হয়েছে। (খাযিন ইত্যাদি)
আয়াত নং- ১০৬
________
অনুবাদ:
১০৬ঃ যখন আমি কোন আয়াতকে রহিত করে দিই কিংবা বিস্মৃত করে দিই (১৯০) তখন এর চেয়ে উত্তম কিংবা এর মতো (কোন আয়াত) নিয়ে আসবো। তোমার কি খবর নেই যে, আল্লাহ্ সবকিছু করতে পারেন?
________
টীকা-১৯০ঃ শানে নুযূলঃ ক্বুরআন কারীম পূর্ববর্তী শরীয়তগুলোর বিধি-বিধান ও কিতাবগুলোকে রহিত করে দিয়েছে। এটা কাফিরদের নিকট অস্বাভাবিক বলে মনে হলো। তারা এটা নিয়ে সমালোচনা করলো। এর জবাবে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, রহিত আয়াতও আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং রহিতকারী (নাসিখ) ও। উভয়ই স্বয়ং হিকমত। কখনো রহিতকারী (আয়াত) রহিতকৃত (আয়াত) অপেক্ষা সহজ ও অধিক কল্যাণকর হয়। আল্লাহর ক্বুদরতে বিশ্বাস স্থাপনকারীর মনে এ বিষয়ে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। সৃষ্টি জগতের মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, আল্লাহ্ تَعَالٰی দিন দ্বারা রাতকে, গ্রীষ্মকাল দ্বারা শীত (ও বসন্ত) কালকে,যৌবন দ্বারা শৈশবকে, অসুস্থতা দ্বারা সুস্থতাকে, (শীত ও) বসন্তকাল দ্বারা হেমন্তকালকে রহিত করেন। এসব রহিতকরণ এবং পরিবর্তন হচ্ছে তাঁরই ক্বুদরতের দলীল।
সুতরাং এক আয়াত কিংবা একটা নির্দেশ রহিত হওয়ায় আশ্চর্যের কি আছে?
রহিতকরণের মাধ্যমে বস্তুতঃ পূর্ববর্তী (রহিতকৃত) হুকুমের মেয়াদ বা সময়সীমার বর্ণনা করা হয়। অর্থাৎ উক্ত হুকুমটা এ মেয়াদের জন্যই ছিলো এবং যথাযথ হিকমত ছিলো।
কাফিরদের অজ্ঞতা যে, তারা রহিতকরণের উপর আপত্তি করে থাকে।
আর আহললে কিতাব (ইহুদী ও খৃষ্টান)-এর আপত্তি তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকেও ভুল। (কারণ,) তাদেরকে অবশ্যই হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام)-এর শরীয়তের বিধি-বিধান রহিত হয়ে যাওয়ার কথা মেনে নিতে হয়। তদুপরি, এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, তাদের পূর্বে প্রতি শনিবার পার্থিব কাজ কারবার হারাম বা নিষিদ্ধ ছিলোনা, (পরে) তাদের উপরই হারাম করা হয়েছে। একথাও তাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, তাওরীতে হযরত নূহ (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর উম্মতের জন্য সমস্ত চতুষ্পদ প্রাণী হালাল বলে ঘোষণা করা হয়। হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর উপরও অনেক প্রাণী হারাম করে দেয়া হয়। এসব সত্ত্বেও রহিতকরণের যৌক্তিকতাকে অস্বীকার করা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?
মাসআলাঃ যেভাবে এক আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে যায়, তেমনি ‘হাদীস-ই-মুতাওতির’ * দ্বারাও (আয়াত) রহিত হয়ে থাকে। (* যে হাদীসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমভাবে এমন বিরাট সংখ্যক বর্ণনাকারী থাকেন, যাঁদের মিথ্যার উপর একমত হওয়া বিশ্বাসযোগ্য নয় বা অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়- তা মুহাদ্দেসীন কিরামের পরিভাষায় ‘হাদীস-ই-মুতাওয়াতির’।)
মাসআলাঃ কখনো শুধু ‘তিলাওয়াত’ রহিত হয়, কখনো শুধু হুকুম। কখনো তিলাওয়াত এবং হুকুম উভয়ই রহিত হয়ে থাকে।
ইমাম বায়হাক্বী (رَحۡمَةُ اللّٰهِ عَلَيۡهِ) হযরত আবূ উমামা (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) থেকে বর্ণনা করেছেন- একজন আনসারী সাহাবী শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতে উঠলেন এবং সূরা ফাতিহার পর একটি সূরা, যা তিনি প্রত্যহ তিলাওয়াত করতেন, পাঠ করতে চেষ্টা করলেন।
কিন্তু তা মোটেই স্মরণে আসলো না এবং ‘বিসমিল্লাহ্’ ছাড়া আর কোন কিছুই পড়তে পারলেন না। ভোরে এ ঘটনা অন্যান্য সাহাবীর নিকট বর্ণনা করলেন।
তাঁরা বললেন, “আমাদেরও একই অবস্থা।” সবাই হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর দরবারে গিয়ে ঘটনা আরয করলেন। হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم ইরশাদ করলেন, “গত রাতে সেই সূরাটা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তিলাওয়াত এবং হুকুম উভয়ই রহিত হয়েছে। এমনকি যেসব কাগজে উক্ত সূরাটা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো, সেগুলোর উপরও এর চিহ্ন পর্যন্ত বাকী থাকেনি।”
আয়াত নং- ১০৭
________
অনুবাদ:
১০৭ঃ তোমাদের কি খবর নেই যে, আল্লাহরই জন্য আসমানসমূহ ও যমীনের বাদশাহী এবং আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের না আছে কোন অভিভাবক এবং না আছে কোন সাহায্যকারী।
আয়াত নং- ১০৮
________
অনুবাদ:
১০৮ঃ তোমরা কি এটাই চাও যে, তোমাদের রসূলকে সেরূপেই প্রশ্ন করবে, যেরূপ মূসার সাথে পূর্বে সংঘটিত হয়েছিলো (১৯১)? আর যে ব্যক্তি ঈমানের পরিবর্তে কুফর গ্রহণ করে (১৯২), সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
________
টীকা-১৯১ঃ শানে নুযূলঃ ইহুদীগণ বলেছিলো, “হে মুহাম্মাদ (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم)! আপনি আমাদের নিকট এমনি একটা কিতাব আনয়ন করুন যা আসমান থেকে একবারই অবতীর্ণ হয়।” তাদের জবাবে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে।
টীকা-১৯২ঃ অর্থাৎ যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে সেগুলো গ্রহণ করার বেলায় অযৌক্তিক বাদানুবাদ করে এবং অন্যান্য আয়াতসমূহ তলব করে।
মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা গেলো যে, যে সব প্রশ্নে ফ্যাসাদের আমেজ থাকে, সেসব প্রশ্ন বুযুর্গদের সামনে উত্থাপন করা জায়েয নয় এবং সবচেয়ে বড় ফ্যাসাদের কারণ হচ্ছে তাই, যা থেকে অবাধ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আয়াত নং- ১০৯
________
অনুবাদ:
১০৯ঃ বহু কিতাবী কামনা করেছে (১৯৩), ‘তারা যদি তোমাদেরকে (তোমাদের) ঈমান আনার পর কুফরের দিকে ফিরিয়ে দিতে পারতো!’ তাদের অন্তরগুলোর বিদ্বেষবশতঃ (১৯৪), এরপর যে, তাদের নিকট সত্য অতিমাত্রায় প্রকাশিত হয়েছিলো। সুতরাং তোমরা ছেড়ে দাও (ক্ষমা করে দাও) ও এড়িয়ে যাও যে পর্যন্ত আল্লাহ্ নিজ হুকুম প্রদান করেন। নিশ্চয়, আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।
________
টীকা-১৯৩ঃ শানে নুযূলঃ উহুদ যুদ্ধের পর ইহুদী সম্প্রদায় হযরত হুযায়ফাহ্ ইবনে ইয়ামান এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا)- কে বলেছিলো, “যদি তোমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে, তবে তোমাদের উপর এ বিপর্যয় আসতো না। কাজেই, তোমরা আমাদের ধর্মের প্রতি ফিরে এসো!’ হযরত আম্মার رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ তাদের জবাবে বলেছিলেন, “বলো তোমাদের মতে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কেমন?” তারা বললো, “অত্যন্ত গর্হিত কাজ।” অতঃপর তিনি বললেন, “আমি তো অঙ্গীকার করেছি যে, আমার জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি বিশ্বকুল সরদার হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) থেকে ফিরবো না। আর কখনো কুফরকে গ্রহণ করবো না।”
আর হযরত হুযায়ফাহ্ (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) বললেন, “আমি সন্তুষ্ট হয়েছি এ কথার উপর যে, আল্লাহ্ আমার প্রতিপালক, মুহাম্মাদ মুস্তফা (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) তাঁর রসূল, ইসলাম একটি সঠিক ধর্ম, ক্বুরআন হচ্ছে ঈমান, কা’বা হচ্ছে ক্বিবলা এবং মু‘মিনগণ হচ্ছেন পরস্পর ভাই ভাই।” অতঃপর এ দু’জন সাহাবী হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর খিদমতে হাযির হলেন এবং তাঁকে (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ঘটনার বিবরণ শুনালেন। হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم ইরশাদ করলেন, “তোমরা যথার্থই করেছো এবং তোমরা সাফল্য লাভ করেছো।” এ প্রসঙ্গে এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে।
টীকা-১৯৪ঃ ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে অবহিত হবার পর ইহুদী সম্প্রদায়ের পক্ষে মুসলমানদের কুফর গ্রহণ ও ধর্মত্যাগ করার আকাঙ্খা করা আর এ কথা কামনা করা যে, তাঁরা (মু’মিনগণ) ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবেন, তাদের বিদ্বেষমূলক মনোভাবের কারণেই ছিলো। বস্তুতঃ ‘বিদ্বেষ’ এক জগন্য দোষ।
মাসআলাঃ হাদীস শরীফ বর্ণিত, হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ইরশাদ করেন, “হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকো। হিংসা পূণ্যগুলোকে তেমনভাবে গ্রাস করে, যেমনিভাবে আগুন শুষ্ক কাঠকে।”
মাসআলাঃ ‘হাসাদ’ (হিংসা) করা হারাম।
মাসআলাঃ যদি কেউ তার ধন-সম্পদ ও সামাজিক প্রভাব দ্বারা গোমরাহী ও বে-দ্বীনি প্রসার করে তবে তার ফিৎনা থেকে রক্ষা পাবার জন্য তার ধ্বংস ও প্রভাবের অবসান কামনা করা হিংসার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং হারামও নয়।
আয়াত নং- ১১০
________
অনুবাদ:
১১০ঃ এবং নামায কায়েক রাখো ও যাকাত দাও (১৯৫)। নিজেদের আত্মাগুলোর জন্য যে উত্তম কাজ পূর্বে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকট পাবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ আমাদের কাজ প্রত্যক্ষ করছেন।
________
টীকা-১৯৫ঃ মু’মিনদেরকে ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করা ও তাদেরকে উপেক্ষা করার নির্দেশ দেয়ার পর তাঁদেরকে স্বীয় আত্মার পরিশুদ্ধির প্রতি মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করছেন।
0 মন্তব্যসমূহ