সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ১২১-১৩০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ১২১
________
অনুবাদ:
১২১ঃ যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা যেমনি উচিত, তা পাঠ করে। তারাই তার উপর ঈমান রাখে। আর যারা এটাকে অস্বীকার করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত (২২১)।
________
টীকা-২২১ঃ শানে নুযূলঃ হযরত ইবনে আব্বাস (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا) বলেছেন, “এ আয়াত শরীফ ‘আহলে সফীনা’ * সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যাঁরা হযরত জাফর ইবনে আবী তালিব (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) এর সাথে হুযূর রসূল কারীম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর দরবারে হাযির হয়েছিলেন।
তাঁদের সংখ্যা ছিলো ৪০। তন্মোধ্যে ৩২ জন আবিসিনিয়াবাসী আর ৮ জন সিরীয় ধর্মগুরু। তাঁদের মধ্যে ‘বুহায়রা’ নামক পাদ্রীও ছিলেন।
অর্থ এ যে, বস্তুতঃ এ তাওরীতের উপর ঈমান স্থাপনকারী তারাই, যারা সেটার যথাযথ তিলাওয়াত করে থাকে, পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন ছাড়াই পাঠ করে ও মান্য করে। আর এর মধ্যে সৃষ্টিকুল সরদার হুযূর মুহাম্মদ মুস্তফা (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর প্রশংসা ও গুণাবলী দেখে হুযূরের উপর ঈমান আনে। সুতরাং হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে যে অবিশ্বাস করে সে তাওরীতের উপর ঈমান রাখে না।
[[* হযরত জাফর তাইয়্যার (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) প্রথমাবস্থায় আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। যখন নাবী কারীম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) মাদীনা শরীফে হিজরত করলেন এবং সেখানে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো, চতুর্দিকে মুসলমানদের প্রতি মাদীনা শরীফে হিজরত করে আসার নির্দেশ হলো, তখন আবিসিনিয়ায় আশ্রিত মুসলমানদের দলটি হযরত জাফর (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ) এর নেতৃত্বে মাদীনা শরীফের দিকে ‘সফীনা’ বা নৌযান যোগে রওয়ানা দিয়েছিলেন। এজন্য তাঁরা ‘আহলে সফীনা’ ‘নৌযান আরোহী দল’ নামে প্রসিদ্ধ।]]
আয়াত নং- ১২২
________
অনুবাদ:
১২২ঃ হে য়া’কুবের বংশধরগণ! স্মরণ করো আমার ঐ অনুগ্রহকে, যা আমি তোমাদের উপর করেছি। আর ওটাও যে, আমি সে যুগের সকলের উপর তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছি।
আয়াত নং- ১২৩
________
অনুবাদ:
১২৩ঃ এবং ভয় করো সেই দিনকে, যেদিন কোন প্রাণ অন্য কারো প্রাণের বিনিময় হবেনা এবং না তাকে কিছু বিনিময় নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে এবং না কাফিরদেরকে কোন সুপারিশ উপকার করবে (২২২) এবং না তাদেরকে সাহায্য করা হবে।
________
টীকা-২২২ঃ এতে ইহুদীদের উক্তির খন্ডন করা হয়েছে। তারা বলতো,“আমাদের পিতৃপুরুষগণ বুযুর্গ ছিলেন। তাঁরা আমাদেরকে সুপারিশ করে মুক্ত করে নেবেন।” এ আয়াতে এ বলে তাদেরকে নিরাশ করা হচ্ছে যে, সুপারিশ কাফিরদের জন্য নয়।
আয়াত নং- ১২৪
________
অনুবাদ:
১২৪ঃ এবং যখন (২২৩) ইব্রাহীমকে তাঁর প্রতিপালক কতিপয় কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন (২২৪); অতঃপর তিনি সেগুলোকে পূর্ণ করে দেখিয়েছেন (২২৫)।(আল্লাহ) ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের ইমাম সাব্যস্তকারী হই।’ (হযরত ইব্রাহীম) আরয করলেন, ‘এবং আমার বংশধরদের মধ্যে থেকেও।’ (আল্লাহ) ইরশাদ করলেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি অত্যাচারীদের ভাগ্যে জোটেনা (২২৬)।
________
টীকা-২২৩ঃ হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর জন্ম হয় আহ্ওয়ায প্রদেশের ‘সূস’ নামক স্থানে। অতঃপর তাঁর পিতা তাঁকে নামরূদের রাজ্য ‘বাবেল’ (ব্যাবিলন) এ নিয়ে আসেন। ইহুদী, খৃষ্টান এবং আরবের অংশীবাদীগণ (মুশরিকগণ) ও সবাই তাঁর উন্নত মর্যাদার কথা স্বীকার করে। আর তারা তাঁর বংশে জন্মগ্রহণ করার উপর গৌরব করে। আল্লাহ্ تَعَالٰی তাঁর ঐসব অবস্থা বর্ণনা করেছেন, যেগুলোর কারণে সকলের উপর ইসলাম কবূল করা অপরিহার্য হয়ে যায়। কেননা, যেসব বিষয় ‘আল্লাহ্ تَعَالٰی তাঁর উপর অপরিহার্য করেছেন, সেগুলো ইসলামের বৈশিষ্টসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
টীকা-২২৪ঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی এর পরীক্ষা হলো- বান্দার উপর কোন দায়িত্ব অপরিহার্য করে দিয়ে অন্যান্যদের নিকট সেটা ‘ভাল কিংবা মন্দ হওয়া’ কে প্রকাশ করে দেন।
টীকা-২২৫ঃ যে সব কথা আল্লাহ্ تَعَالٰی হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর উপর পরীক্ষার জন্য ওয়াজিব করেছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে ক্বুরআনের ব্যাখ্যাকারীদের কতিপয় অভিমত রয়েছে-হযরত ক্বাতাদাহ্ رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ
এর অভিমত হচ্ছে- সেগুলো হজ্জের বিধান। হযরত মুজাহিদ বলেছেন, এ থেকে দশটা কাজ বুঝানো উদ্দেশ্য, যেগুলো পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।
হযরত ইবনে আ’ব্বাস رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا এর অভিমত হচ্ছে- ঐ দশটা কাজ হচ্ছেঃ (১) গোঁফ ছোট করা, (২) কুল্লী করা, (৩) নাকে পরিচ্ছন্নতার জন্য পানি ব্যবহার করা, (৪) মিস্ওয়াক করা, (৫) মাথায় সিঁথি কাটা, (৬) নখ কাটা, (৭) বগলের লোম পরিষ্কার করা, (৮) নাভীতল পরিষ্কার করা, (৯) খতনা করা এবং (১০) পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা। এসব কাজ হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর উপর ওয়াজিব ছিলো। তবে আমাদের উপর এগুলোর কতেক করা ওয়াজিব এবং কতেক সুন্নাত।
টীকা-২২৬ঃ মাসআলাঃ অর্থাৎ তাঁর বংশধরদের মধ্যে যারা অত্যাচারী (কাফির) তারা ইমামতের পদ-মর্যাদা পাবেনা।
মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা গেলো যে, কাফির মুসলমানদের নেতা হতে পারে না। আর মুসলমানদের জন্য কাফিরদের অনুসরণ করা জায়িয হবে না।
আয়াত নং- ১২৫
________
অনুবাদ:
১২৫ঃ এবং (স্মরণ করুন,) যখন আমি এ ঘরকে (২২৭) মানবজাতির জন্য আশ্রয়স্থল ও নিরাপদ স্থান করেছি (২২৮) এবং (বলেছিলাম,) ইব্রাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করো (২২৯)!’ এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে তাগিদ দিয়েছিলাম, ‘আমার ঘরকে খুব পবিত্র করো-তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী এবং রুকূ’ ও সাজদাকারীদের জন্য।
________
টীকা-২২৭ঃ ‘বায়ত’ (ঘর) কা’বা শরীফ বুঝানো হয়েছে। এর মধ্যে সমগ্র ‘হেরম শরীফও’ শামিল রয়েছে।
টীকা-২২৮ঃ ‘নিরাপদ স্থল’ করার এই অর্থ যে, কা’বার হেরম শরীফে হত্যা ও লুন্ঠন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিংবা এর অর্থ- সেখানে শিকারের জন্তুর পর্যন্ত নিরাপত্তা রয়েছে। এমনকি, হেরম শরীফের অভ্যন্তরে সিংহ এবং বাঘ ইত্যাদিও শিকারকে ধাওয়া করে না; বরং ছেড়ে দিয়ে ফিরে যায়। অন্য এক অভিমত হলো- মু’মিন বান্দা এতে প্রবেশ করে আল্লাহর কঠিন আযাব বা শাস্তি থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। ‘হেরম’- কে হেরম এ জন্য বলা হয় যে, এর অভ্যন্তরে হত্যা, যুলুম ও শিকার করা হারাম ও নিষিদ্ধ। (তাফসীর-ই-আহমাদী)
যদি কোন দোষী ব্যক্তিও তাতে প্রবেশ করে, তবে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। (মাদারিক)
টীকা-২২৯ঃ ‘মাক্বাম-ই-ইব্রাহীম’ হচ্ছে- ঐ পাথর, যার উপর দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) কা’বা মু‘আয্যামাহ্’ নির্মান করেছিলেন। আর এর উপর তাঁর (হযরত ইব্রাহীম عَلَیۡهِ السَّلَام এর ক্বদম মুবারকের চিহ্ন বিদ্যমান। এটাকে নামাযের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করার হুকুম ‘মুস্তাহাব নির্দেশক।’ অন্য এক অভিমত হচ্ছে- উক্ত নামায দ্বারা তাওয়াফের দু’রাক‘আত নামাযই উদ্দেশ্য। (আহমাদী ইত্যাদি)
আয়াত নং- ১২৬
________
অনুবাদ:
১২৬ঃ এবং যখন ইব্রাহীম আরয করলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! এ শহরকে নিরাপদ করে দাও! আর এর অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন ধরণের ফল থেকে জীবিকা দান করো! যারা তাদের মধ্যে আল্লাহ্ ও পরকালের উপর ঈমান আনবে (২৩০)।’ ইরশাদ করলেন,‘এবং যারা কাফির হবে তাদেরকেও এর সামান্য ভোগ করার জন্য দেবো। অতঃপর তাদেরকে দোযখের কঠিন শাস্তির দিকে (ধাবিত হতে) বাধ্য করবো এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান ফিরে যাবার।’
________
টীকা-২৩০ঃ যেহেতু ‘ইমামত’ এর ক্ষেত্রে ۡ لَا یَنَالُ عَہۡدِی الظّٰلِمِیۡنَ [আমার প্রতিশ্রুতি (ইমামত) যালিমদের ভাগ্যে জোটেনা।] ইরশাদ হয়েছিলো, সেহেতু হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) তাঁর প্রার্থনায় শুধু মু’মিনদেরকেই খাস করেছেন। বস্তুতঃ এটাই আদবের মহিমা। আল্লাহ্ تَعَالٰی মেহেরবানী করেছেন, তাঁর প্রার্থনা কবূল করেছেন এবং ইরশাদ করেছেন, “জীবিকা সবাইকে দেয়া হবে- মু’মিনদেরকেও কাফিরদেরকেও।” কিন্তু কাফিরদের জীবিকা হবে নগণ্য। অর্থাৎ শুধু পার্থিব জীবনেই তারা উপকৃত হতে পারবে।
আয়াত নং- ১২৭
________
অনুবাদ:
১২৭ঃ এবং যখন উঠাচ্ছিল ইব্রাহীম এ ঘরের ভিত্তিগুলো এবং ইসমাঈল, এ প্রার্থনারত অবস্থায়- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করো (২৩১)। নিশ্চয় তুমিই শ্রোতা, জ্ঞাতা।
________
টীকা-২৩১ঃ প্রথমবার কা’বা শরীফের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام); এবং নূহ (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর তুফানের পর হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) সেই ভিত্তির উপর তা নির্মান করেছিলেন। এ বিশেষ নির্মানকাজ তাঁরই পবিত্র হস্তে সম্পাদিত হয়। এর জন্য পাথর সংগ্রহ করে আনার খিদমত ও সৌভাগ্য হযরত ইসমাঈল عَلَیۡهِ السَّلَام এর ভাগ্যেও জুটেছিলো। উভয় মহান ব্যক্তিত্ব তখন এ প্রার্থনাই করেছিলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এ খিদমত ও বন্দেগী গ্রহণ করো।”
আয়াত নং- ১২৮
________
অনুবাদ:
১২৮ঃ হে প্রতিপালক আমাদের! এবং আমাদেরকে তোমারই সামনে গর্দান অবনতকারী (২৩২) এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে একটা উম্মতকে তোমারই অনুগত করো। আমাদেরকে আমাদের ‘ইবাদতের নিয়ম-কানুন বলে দাও এবং আমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহ সহকারে দৃষ্টিপাত করো (২৩৩)। নিশ্চয় তুমিই অত্যন্ত তাওবা কবূলকারী, দয়ালু।
________
টীকা-২৩২ঃ এ মহা সম্মানিত ব্যক্তিদ্বয় আল্লাহর একান্ত অনুগত এবং নিতান্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। এতদসত্ত্বেও তাঁদের এ প্রার্থনা এ জন্যই ছিলো যে, (তাঁরা) আনুগত্য ও নিষ্ঠায় আরো অধিক পূর্ণতার আকাংখা পোষণ করেন। বন্দেগীর স্বাদ কখনো মিটেনা।سُبۡحٰنَ اللّٰهُ সুবহানাল্লাহ! যেমন কবি বলেন, فكر هر كس بقدر همت اوست অর্থাৎ প্রত্যেকের চিন্তাধারা তার হিম্মত অনুপাতেই হয়’।
টীকা-২৩৩ঃ হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) ছিলেন ‘মা‘সূম’ বা নিষ্পাপ। তাঁদের পক্ষ থেকে এটা নিতান্ত বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ এবং আল্লাহ্-ওয়ালাদের জন্য শিক্ষার আদর্শ ছিলো।
মাসআলাঃ এ স্থানটা প্রার্থনা কবূল হবারই এবং এখানে দুআ’ ও তাওবা করা হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর সুন্নাত।
আয়াত নং- ১২৯
________
অনুবাদ:
১২৯ঃ হে প্রতিপালক আমাদের! এবং প্রেরণ করো তাদের মধ্যে (২৩৪) একজন রসূল তাদেরই মধ্য থেকে, যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবেন এবং তাদেরকে তোমার কিতাব (২৩৫) ও পরিপক্ক জ্ঞান (২৩৬) শিক্ষা দেবেন অতি পবিত্র করবেন (২৩৭)। নিশ্চয়, তুমিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
________
টীকা-২৩৪ঃ অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) এর বংশধরদের অনুকূলে এ দুআ’ নাবীকুল সরদার হযরত (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم)এর জন্যই ছিলো। অর্থাৎ কা‘বা মুআযযামার নির্মাণ কাজের মহান খিদমত সম্পন্ন করা এবং তাওবা ও ইস্তিগফার করার পর হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) এ প্রার্থনাই করেছিলেন- “হে প্রতিপালক! তোমার মাহ্বুব, শেষ যমানার নাবী হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে আমাদেরই বংশের মধ্য থেকে প্রকাশ করো এবং এ মর্যাদা আমাদেরকেই দান করো।” এ প্রার্থনা কবূল হয়েছে এবং হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর পুত্র হযরত ইসমাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর বংশের মধ্যে হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ব্যতীত আর কোন নাবী আসেন নি। হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর বংশের মধ্যে অন্যান্য নাবীগন হযরত ইসহাক্ব (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর বংশ থেকে আবির্ভূত হন।
মাসআলাঃ বিশ্বকুল সরদার হুযূর কারীম, রাঊফুর রাহীম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم স্বীয় মিলাদ শরীফ নিজেই বর্ণনা করেছেন। ইমাম বাগাভী (رَحۡمَةُ اللّٰهِ عَلَيۡهِ) একটা হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ইরশাদ করেন, “আমি আল্লাহ্ تَعَالٰی এর নিকট ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’ (শেষ নাবী) হিসেবেই লিখিত ছিলাম এমতাবস্থায়ই, যখন হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর পবিত্র গড়নের খামীর তৈরি হচ্ছিলো। আমি তোমাদেরকে আমার প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছি- আমি হলাম হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) এর দুআ’, হযরত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর সুসংবাদ, আমি আপন মহীয়সী মাতার সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা, যা তিনি আমার বেলাদতের সময় দেখেছিলেন এবং তাঁর সামনে একটা উজ্জ্বল ‘নূর’ প্রকাশিত হয়েছিলো, যার আলোকে সিরিয়ার রাজ-প্রাসাদ এবং অট্টালিকাগুলো তাঁর চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছিলো।” এ হাদীসে হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর প্রার্থনা বলতে ঐ প্রার্থনাকেই বুঝায়, যা এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ تَعَالٰی এ দুআ’ কবূল করেছেন এবং শেষ যমানায় নাবীকূল সরদার হুযূর মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে প্রেরণ করেছেন। তাঁর এ অনুগ্রহের উপর আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা। (জুমাল ও খাযিন)
টীকা-২৩৫ঃ ‘এ কিতাব’ দ্বারা ‘পবিত্র ক্বুরআন’ এবং ‘এর শিক্ষা’ দ্বারা এর ‘তত্ত্ব ও অর্থসমূহ শিখানো’ বুঝানো হয়েছে।
টীকা-২৩৬ঃ ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে অনেক অভিমত রয়েছে- কারো মতে, ‘হিকমত’ অর্থ ‘ফিক্বহ’। হযরত ক্বাতাদাহর অভিমতানুসারে, ‘হিকমত’ সুন্নাহরই নাম। কেউ কেউ বলেন, ‘হিকমত’‘আহকাম’ (বিধি-বিধান) সম্বন্ধনীয় জ্ঞানকেই বলা হয়। সারকথা হলো- ‘হিকমত’ হচ্ছে ‘ইলমে আসরার বা গৃঢ় রহস্যসমূহের জ্ঞান’।
টীকা-২৩৭ঃ ‘পবিত্র করা’র এ অর্থ যে, সত্তা ও আত্মাসমূহের ফলক (বা মূল উপাদান) কে ময়লা থেকে পবিত্র করে পর্দা অপসারণ করা এবং যোগ্যতার লুক্কায়িত শক্তির আয়নাকে পরিষ্কার করে সেগুলোকে এমন যোগ্য করে তোলা যেন সেগুলোর মধ্যে সৃষ্টির তত্তসমূহ উদ্ভাসিত হতে পারে।
আয়াত নং- ১৩০
________
অনুবাদ:
১৩০ঃ এবং ইব্রাহীমের দ্বীন থেকে কে বিমুখ হবে (২৩৮) ঐ ব্যক্তি ব্যতিত, যে অন্তরের (দিক দিয়ে) নির্বোধ? এবং নিশ্চয় নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে তাকে মনোনীত করে নিয়েছি (২৩৯); এবং নিশ্চয় সে পরকালে আমার খাস নৈকট্যের উপযোগীদের অন্তর্ভুক্ত (২৪০)
________
টীকা-২৩৮ঃ শানে নুযূলঃ ইহুদী আ’লিমদের মধ্য থেকে হযরত আ’বদুল্লাহ্ ইবনে সালাম ইসলাম গ্রহণ করার পর স্বীয় দুই ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাজির ও সালামাহ্কে ইসলামের দিকে আহ্বান করলেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমাদের জানা আছে যে, আল্লাহ্ تَعَالٰی তাওরীতে ইরশাদ করেছেন-আমি হযরত ইসমাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর বংশধর থেকে একজন নাবী পয়দা করবো, যাঁর নাম হবে ‘আহমাদ। যে ব্যক্তি তার উপর ঈমান আনবে সে সঠিক রাস্তা পাবে। আর যে ব্যক্তি ঈমান আনবে না সে মালঊ’ন (অভিশপ্ত)।” একথা শুনে সালামাহ্ ঈমান আনলেন;কিন্তু মুহাজির ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো।
এ ঘটনার পর আল্লাহ্ تَعَالٰی এ আয়াত শরীফ নাযিল করে একথা প্রকাশ করে দিলেন যে, যখন হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) নিজেই এ মহাসম্মানিত রসূল প্রেরিত হবার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, তখন যে ব্যক্তি তাঁর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর দ্বীন থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
এর মধ্যে ইহুদী, খৃষ্টান, আরবের মুশরিকদের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, যারা গর্ব করে ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর সাথে নিজেদের সম্পর্কের দাবী করতো। যখন তারা তাঁর (হযরত ইব্রাহীম عَلَیۡهِ السَّلَام) দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো তখন তাদের আর আভিজাত্য রইলো কোথায়?
টীকা-২৩৯ঃ ‘রিসালাত’ ও ‘বন্ধুত্ব’ দ্বারা যথাক্রমে রসূল ও বন্ধু (খলীল) করেছেন।
টীকা-২৪০ঃ যাঁদের জন্য রয়েছে উন্নত মর্যাদাসমূহ। কাজেই, যখন হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) উভয় জাহানে সম্মানের অধিকারী, তখন তাঁর তরীক্বা এবং ধর্ম থেকে যে বিরত থাকে সে নিঃসন্দেহে অজ্ঞ ও নির্বোধ।
0 মন্তব্যসমূহ