সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ১৩১-১৪০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ১৩১
________
অনুবাদ:
১৩১ঃ যখন তাকে তাঁর প্রতিপালক বললেন, ‘গর্দান অবনত করো (আত্মসমর্পণ করো)! আরয করলো, ‘আমি গর্দান অবনত করেছি তাঁরই জন্য, যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক।
আয়াত নং- ১৩২
________
অনুবাদ:
১৩২ঃ এবং সেই দ্বীন সম্পর্কে ওসীয়ত করেছিলো স্বীয় পুত্রদেরকে এবং ইয়া’কূবও- ‘হে আমার পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করে নিয়েছেন। সুতরাং মৃত্যুবরণ করো না, কিন্তু মুসলমান হয়ে।’
আয়াত নং- ১৩৩
________
অনুবাদ:
১৩৩ঃ বরং তোমাদের মধ্য থেকে (তোমরা) নিজেরাই উপস্থিত ছিলে (২৪১) যখন য়া’কূবের নিকট মৃত্যু এসেছিলো; যখনই তিনি আপন পুত্রদেরকে বলেছিলেন, ‘আামার পরে কার ইবাদত করবে?’ (তারা) আরয করলো, ‘আমরা ইবাদত করবো তাঁরই, যিনি খোদা হন আপনার এবং আপনার পিতামহ ইব্রাহীম, ইসমাঈল (২৪২) এবং ইসহাক্বের, একমাত্র খোদা; এবং আমরা তাঁরই সামনে গর্দান রেখেছি।
________
টীকা-২৪১ঃ শানে নুযূলঃ এ আয়াত শরীফ ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। তারা বলেছিলো যে, হযরত য়া’কূব (عَلَیۡهِ السَّلَام) তাঁর ওফাতের দিন স্বীয় বংশধরদেরকে ইহুদী মতবাদেই প্রতিষ্ঠিত থাকার ওসীয়ত করে গিয়েছিলেন। আল্লাহ্ تَعَالٰی এদের এ মিথ্যা অপবাদের জবাবে এ আয়াত শরীফ নাযিল করেছেন- (খাযিন)। অর্থাৎ (ইরশাদ করেন,) হে বানী ইসরাঈল! তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণ হযরত য়া’কূব (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর (ইহ জীবনের) শেষ মুহুর্তে তাঁরই নিকট উপস্থিত ছিলেন, যখন স্বীয় পুত্রদের ডেকে তাদের নিকট থেকে ইসলাম ও আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকারোক্তি নিয়েছিলেন। আর সেই স্বীকারোক্তি ছিলো যা আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।
টীকা-২৪২ঃ হযরত ইসমাঈল عَلَیۡهِ السَّلَام কে (আয়াতে) হযরত য়া’কূব (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর পূর্ব পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত করা এ জন্যই ছিলো যে, তিনি তাঁর চাচা হন।চাচা পিতারই স্থলাভিষিক্ত। যেমন, হাদীস শরীফেও বর্ণিত হয়েছে। তাঁর (হযরত ইসমাঈল) নাম হযরত ইসহাক্ব (عَلَیۡهِ السَّلَام এর পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে দু’টি কারণে। একটি কারণ হচ্ছেঃ তিনি হযরত ইসহাক্ব (عَلَیۡهِ السَّلَام) অপেক্ষা বয়সে চৌদ্দ বছরের বড় ছিলেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছেঃ তিনি নাবীকুল সরদার হুযূর কারীম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর পিতামহ।
আয়াত নং- ১৩৪
________
অনুবাদ:
১৩৪ঃ এ (২৪৩) এক উম্মত; যারা গত হয়েছে (২৪৪), তাদের জন্য রয়েছে যা তারা অর্জন করেছে এবং তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা অর্জন করবে; এবং তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তোমাদেরকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
________
টীকা-২৪৩ঃ অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম ও হযরত য়া’কূব (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) এবং তাঁদের মুসলিম বংশধরগণ।
টীকা-২৪৪ঃ হে ইহুদীরা! তোমরা তাদের নামে মিথ্যা রটনা করো না।
আয়াত নং- ১৩৫
________
অনুবাদ:
১৩৫ঃ এবং কিতাবীরা বললো (২৪৫), ‘ইহুদী কিংবা খৃষ্টান হয়ে যাও, ঠিক পথ পাবে!’ (হে হাবীব!) আপনি বলুন, ‘বরং আমিতো ইব্রাহীমের দ্বীনকেই গ্রহণ করছি, যিনি সব রকমের বাতিল থেকে মুক্ত ছিলেন এবং মুশরিকদের অন্তভুর্ক্ত ছিলেন না (২৪৬)।
________
টীকা-২৪৫ঃ শানে নুযূলঃ হযরত ইবনে আ’ব্বাস رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا বর্ণনা করেছেন, এ আয়াত শরীফ ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতৃবন্দ এবং নাজরানবাসী খৃষ্টানদের জবাবে নাযিল হয়েছে।
ইহুদীরা তো মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছিলো যে, হযরত মূসা عَلَیۡهِ السَّلَام -ই সমস্ত নাবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর তাওরীত সব কিতাব অপেক্ষা উত্তম এবং ইহুদী ধর্মই সব ধর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এতদসঙ্গে, তারা হযরত সরওয়ারে কা-ইনাত মুহাম্মাদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم, ইঞ্জীল এবং ক্বুরআনকে অস্বীকার করে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো, “তোমরা ইহুদী হয়ে যাও” অনুরূপভাবে, খৃষ্টানগণও তাদের ধর্মই একমাত্র সত্য বলে দাবী করে মুসলমানদেরকে খৃষ্টান হয়ে যাওয়ার আহ্বান করেছিলো। এ জবাবে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে।
টীকা-২৪৬ঃ এ আয়াতে ইহুদী ও খৃষ্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, তোমরা তো মুশরিক (অংশীবাদী)। এ জন্য তোমাদের হযরত ইব্রাহীম عَلَیۡهِ السَّلَام এর ধর্মের অনুসারী বলে দাবী করা ভিত্তিহীন।
অতঃপর মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ হচ্ছে যেন তারাও ইহুদী এবং খৃষ্টানদেরকে বলে দেয়- “আমরা তো ঈমান এনেছি।” (আয়াত দেখুন!)
আয়াত নং- ১৩৬
________
অনুবাদ:
১৩৬ঃ এভাবে আরয করো, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং তারই উপর, যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে আর যা অবতারণ করা হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, য়া’কূব এবং তাঁরই বংশধরদের উপর। আর (তারই উপর,) যা দান করা হয়েছে অন্যান্য নাবীগণকে তাঁদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। আমরা তাঁদের কারো উপর ঈমান আনার ক্ষেত্রে পার্থক্য করিনা এবং আমরা আল্লাহর সামনে গর্দান রেখেছি।
আয়াত নং- ১৩৭
________
অনুবাদ:
১৩৭ঃ অতঃপর তারাও যদি এভাবে ঈমান আনতো, যেমন তোমরা এনেছো, তবে তো তারা হিদায়ত (সঠিক পথের দিশা) পেয়ে যেতো। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তারা নিরেট একগুঁয়েমীর মধ্যে রয়েছে (২৪৭)। তবে হে মাহবুব! অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ্ই তাদের দিক থেকে আপনার জন্য যথেষ্ঠ হবেন এবং তিনিই শ্রোতা, জ্ঞাতা (২৪৮)।
________
টীকা-২৪৭ঃ এবং তাদের মধ্যে সত্য-সন্ধানের চিহ্নও নেই।
টীকা-২৪৮ঃ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি যে, তিনি স্বীয় হাবীব صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে আধিপত্য দান করবেন। এর মধ্যে অদৃশ্যের সংবাদও রয়েছে যে,ভবিষ্যতে অর্জিত হবে এমন বিজয়ের কথা প্রথম থেকেই প্রকাশ করেছেন। এতে নাবী কারীম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর এ মু’জিযার বহিঃপ্রকাশ ঘটে যে, আল্লাহ্ تَعَالٰی এর এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়েছে। আর এ অদৃশ্যের সংবাদও সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কাফিরদের বিদ্বেষ, গোঁড়ামী এবং ষড়যন্ত্রগুলোর কারণে হুযূর আল্লাহ্ تَعَالٰی এর কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি। হুযূর আল্লাহ্ تَعَالٰی ই জয়ী হয়েছেন। বনূ ক্বোরায়যাকে হত্যা করা হলো, বনূ নযীর আপন জন্মস্থান থেকে বহিষ্কৃত হলো। আর ইহুদী ও খৃষ্টানদের উপর ‘জিয্য়া’ অবধারিত হলো।
আয়াত নং- ১৩৮
________
অনুবাদ:
১৩৮ঃ আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি (২৪৯) এবং আল্লাহর রং অপেক্ষা কার রং অধিক উত্তম? এবং আমরা তাঁরই ইবাদত করি।
________
টীকা-২৪৯ঃ অর্থাৎ যেভাবে রং কাপড়ের বাইরে ও ভিতরে প্রসারিত হয়, অনুরূপভাবে, আল্লাহর দ্বীনের সত্য বিশ্বাসগুলোও আমাদের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের ভিতরে ও বাইরে, অন্তরে ও শরীর তাঁরই রঙে রঞ্জিত হয়ে গেছে। আমাদের রং (শুধু) জাহেরী রং নয়, যা কোন উপকারেই করে না; বরং এটা অন্তরসমূহকে পবিত্র করে। বাইরে এর চিহ্নসমূহ চালচলন ও কার্যকলাপ থেকে প্রকাশ পায়। খৃষ্টানগণ যখন আপন ধর্মে দাখিল করে কিংবা তাদের নিকট কোন সন্তান জন্ম নেয় তখন তারা পানিতে হলদে রং মিশিয়ে তাতে সে ব্যক্তি কিংবা পুত্রকে ডুব দেয়ায় আর বলে থাকে, “এখন সে প্রকৃত খৃষ্টান হয়েছে”। এ আয়াতে এরই খন্ডন করা হয়েছে যে, এ জাহেরী রং কোন কাজে আসবে না।
আয়াত নং- ১৩৯
________
অনুবাদ:
১৩৯ঃ (হে হাবীব!) আপনি বলুন, ‘আল্লাহ্ সম্পর্কে (আমাদের সাথে) কি (তোমরা) বিতর্ক করছো (২৫০)? অথচ তিনি আমাদেরও মালিক এবং তোমাদেরও (২৫১); এবং আমাদের কর্ম আমাদের সাথে আর তোমাদের কর্ম তোমাদের সাথে; এবং আমরা শুধু তাঁরই (২৫২);
________
টীকা-২৫০ঃ শানে নুযূলঃ ইহুদীগণ মুসলমানদেরকে বলেছিলো, “আমরাই সর্বপ্রথম আসমানী কিতাবপ্রাপ্ত। আমাদের ক্বিবলাই প্রাচীনতম, আমাদের ধর্মই প্রাচীন। নাবীগণ আমাদের মধ্য থেকে আবির্ভুত হয়েছেন। সুতরাং বিশ্বকুল সরদার মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم যদি নাবী হতেন, তবে তিনি অবশ্যই আমাদের মধ্য থেকে আবির্ভূত হতেন।” তাদের জবাবে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে।
টীকা-২৫১ঃ তাঁরই পূর্ণ ইখতিয়ার। তিনি আপন বান্দাদের মধ্য থেকে যাঁকেই ইচ্ছা নাবী করেন- হোক আরব থেকে, নতুবা অন্য কোন দেশ বা গোত্র থেকে।
টীকা-২৫২ঃ আমরা অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করিনা এবং ইবাদত ও আনুগত্য শুধু তাঁরই জন্য করি। কাজেই, আমরাই প্রকৃত সম্মান ও পুরস্কারের উপযোগী।
আয়াত নং- ১৪০
________
অনুবাদ:
১৪০ঃ বরং তোমরা এটাই বলে থাকো যে, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, য়া’কূব এবং তাঁদের পুত্রগণ ইহুদী কিংবা খৃষ্টান ছিলেন। (হে হাবীব!) আপনি বলুন, ‘জ্ঞান কি আমাদের বেশী, না আল্লাহর (২৫৩)? এবং তার চেয়ে অধিক অত্যাচারী কে, যার নিকট রয়েছে আল্লাহর পক্ষে সাক্ষ্য, আর সে গোপন করে (২৫৪)? এবং খোদা তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অনবহিত নন।’
________
টীকা-২৫৩ঃ এর অকাট্য জবাব হচ্ছে এটাই যে, আল্লাহ্ সর্বাপেক্ষা অধিক জ্ঞাত। কাজেই, তিনিই যখন বলেছেন- مَا كَانَ اِبۡرٰهِیۡمُ یَهُوۡدِیًّاوَّلَا نَصۡرَانِیًّا অর্থাৎ ‘হযরত ইব্রাহীম না ছিলেন ইহুদী, না ছিলেন খৃষ্টান) তখন তোমাদের এ কথা বাতিল ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
টীকা-২৫৪ঃ এটা হচ্ছে ইহুদীদের অবস্থা, যারা আল্লাহ্ تَعَالٰی এর সাক্ষ্যগুলো গোপন করেছে, যা তাওরীতে উল্লেখিত ছিলো, তা হলো, ‘মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم তাঁরই নাবী’। আর তাঁর বৈশিষ্টাবলী হবে এরূপ এবং হযরত ইব্রাহীম عَلَیۡهِ السَّلَام মুসলমানই ছিলেন আর একমাত্র গ্রহণীয় ধর্ম হচ্ছে ইসলাম; ইহুদী বা খৃষ্টান ধর্ম নয়। *
0 মন্তব্যসমূহ