সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৩১-৪০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)
আয়াত নং- ৩১
________
অনুবাদ:
৩১ঃ এবং আল্লাহ্ تَعَالٰی আদমকে যাবতীয় (বস্তুর) নাম শিক্ষা দিলেন (৫৬) অতঃপর সমুদয় (বস্তু) ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপন করে ইরশাদ করলেন, ‘সত্যবাদী হলে এসব বস্তুর নাম বলো তো (৫৭)!’
________
টীকা-৫৬ঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام)- এর সম্মূখে সমুদয় বস্তু ও সব নামীয় বস্তু উপস্থাপন করে তাঁকে সেগুলোর নাম, গুনাবলী, কার্যকারিত, বৈশিষ্টাবলী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কর্ম-কৌশলাদির মৌলিক বিষয়সমূহ- সব কিছুর জ্ঞান ‘ইলহাম’ (ইলহামঃ অন্তরে আল্লাহ্ পক্ষ থেকে যা ইঙ্গিত করা হয়।) সূত্রে দান করেছেন।
টীকা-৫৭ঃ অর্থাৎ যদি তোমরা তোমাদের এ ধারণায় সত্য হও যে, আমি তোমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞানী করে অন্য কোন মাখ্লূক সৃষ্টি করবো না এবং তোমরাই (আমার) খিলাফতের (প্রতিনিধিত্ব করা) জন্য একমাত্র উপযোগী, তবে এ সমস্ত বস্তুর নাম বলে দাও। কেননা, খলীফার দায়িত্ব হচ্ছে- প্রদত্ত ক্ষমতার প্রয়োগ ও কার্য সম্পাদনের ব্যবস্থা করা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আর ঐ সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান ব্যতীত খলীফার এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর নয়, যে গুলোর উপর তাকে কার্য-নির্বাহক করা হয়েছে এবং যেগুলোর ফায়সালা তাঁকে দিতে হবে।
মাসআলাঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی ফিরিশতাদের উপর হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام)- এর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হিসেবে ‘ইলম’ (জ্ঞান)-কেই প্রকাশ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নামসমূহের জ্ঞান (ইলম-ই-আসমা) অর্জন করা নির্জনে ও একাকীভাবে ইবাদতের চাইতে অধিকতর উত্তম।
মাসআলাঃ এ আয়াত থেকে এটাও প্রমাণিত হলো যে, নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) ফিরিশতাকুল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
আয়াত নং- ৩২
________
অনুবাদ:
৩২ঃ (তারা) বললো, ‘পবিত্রতা আপনারই. আমাদের কোন জ্ঞান নেই, কিন্তু (ততটুকুই) যতটুকু আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। নিশ্চয় আপনিই জ্ঞানময়,প্রজ্ঞাময় (৫৮)।’
________
টীকা-৫৮ঃ এর মধ্যে ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে তাঁদের অক্ষমতা ও অপূর্ণতার স্বীকারোক্তি এবং এ কথারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে যে, তাঁদের প্রশ্ন (আদম সৃষ্টির হিকমত সম্পর্কে) জানার আগ্রহ হিসেবে ছিলো, আপত্তি হিসেবে নয়। আর এখন তাঁরা মানুষের মহত্ত্ব এবং তাঁর সৃষ্টির হিকমত সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন, যা তাঁরা পূর্বে জানতেন না।
আয়াত নং- ৩৩
________
অনুবাদ:
৩৩ঃ তিনি ইরশাদ করলেন, ‘হে আদম! বলে দাও তাদেরকে সমুদয় (বস্তুর) নাম।’ যখন তিনি (অর্থাৎ আদম) তাদেরকে সমুদয় বস্তুর নাম বলে দিলেন (৫৯) ইরশাদ করলেন, ‘আমি কি (একথা) বলছিলাম না যে, আমি জানি আসমানসমূহ এবং যমীনের সমস্ত গোপন (অদৃশ্য) বস্তু সম্পর্কে এবং আমি জানি যা কিছু তোমরা প্রকাশ করছো এবং যা কিছু তোমরা গোপন করছো (৬০)?
________
টীকা-৫৯ঃ অর্থাৎ হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) প্রত্যেক বস্তুর নাম ও সৃষ্টির গৃঢ় রহস্য বর্ণনা করেছেন (তখন আল্লাহ্ تَعَالٰی)
টীকা-৬০ঃ ফিরিশতাগণ যে কথাটা প্রকাশ করেছিলো তা ছিলো - ‘মানুষ ফিৎনা-ফ্যাসাদ এবং রক্তপাত করবে।’ আর যে কথাটা গোপন করেছিলেন, তা ছিলো- ‘খলীফা হবার যোগ্য শুধু তাঁরা নিজেরাই এবং আল্লাহ্ تَعَالٰی তাঁদের চেয়ে অধিক উত্তম ও জ্ঞানী কোন মাখ্লূক সৃষ্টি করবেন না।’
মাসআলাঃ এ আয়াত থেকে মানুষের আভিজাত্য এবং জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আর এ কথাও (প্রমাণিত হয়) যে, শিক্ষা দানের সম্বন্ধ আল্লাহ্ تَعَالٰی এর প্রতি করা শুদ্ধ, যদিও তাকে ‘শিক্ষক’ নামে অভিহিত করা যায় না। কেননা ‘শিক্ষক’ পেশাদার শিক্ষাদাতাকে বলা হয়।
মাসআলাঃ এ থেকে এ কথাও জানা যায় যে, সমস্ত শব্দ ও ভাষা আল্লাহ্ تَعَالٰی এর পক্ষ থেকেই প্রদত্ত।
মাসআলাঃ এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, ফিরিশতাদের জ্ঞান ও পূর্ণতাগুলো ক্রমবর্দ্ধিত হয়।
আয়াত নং- ৩৪
________
অনুবাদ:
৩৪ঃ এবং (স্মরণ করুন!) যখন আমি ফিরিশতাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, ‘তোমরা আদমকে সাজদা করো।’ তখন সবাই সাজদা করেছিলো, ইবলীস ব্যতীত; সে অমান্যকারী হলো ও অহংকার করলো এবং কাফির হয়ে গেলো (৬১)
________
টীকা-৬১ঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর নমুনা (موجودات) এবং রূহানী জগত ও শরীর জগতের ‘সমষ্টি’ করে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাঁদেরকে হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা, এতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার এবং নিজেদের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা প্রর্থনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
কোন কোন তাফসীরকারকের অভিমত হচ্ছে- আল্লাহ্ تَعَالٰی হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে সৃষ্টি করার পূর্বেই ফিরিশতাদেরকে (তাঁকে) সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁদের দলীল হচ্ছে নিম্নলিখিত আয়াত শরীফ- (অর্থাৎ ‘যখন আমি তাঁকে সুঠাম করবো এবং তাতে আমার রুহ সঞ্চার করবো, তখন তোমরা তাঁর প্রতি সাজদাবনত হয়ো।’ সূরা স-দ্) (বায়দাভী শরীফ)
সাজদার নির্দেশ সমস্ত ফিরিশতাদেরকেই দেয়া হয়েছিলো। এটাই বিশুদ্ধতম অভিমত। (খাযিন)
মাসআলাঃ সাজদা দু’প্রকার। যথা- (১) ‘সাজদা-ই-ইবাদত’, যা ইবাদতের উদ্দেশ্যেই করা হয় এবং (২) ‘সাজদা-ই-তাহিয়্যাহ্’ যাতে সাজদাকৃতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই উদ্দেশ্য হয়; ইবাদত নয়।
মাসআলাঃ ‘সাজদা-ই-ইবাদত’, আল্লাহ্ تَعَالٰی এর জন্য খাস; তা অন্য কারো জন্য হতে পারে না। এমনকি কোন শরীয়তেই জায়েয ছিলো না। এ আয়াতে যেসব তাফসীরকারক (সাজদাহ্ দ্বারা) ‘সাজদা-ই-ইবাদত’, এর কথা বুঝিয়েছেন, তাঁরা বলেন, ‘সাজদা আল্লাহ্ تَعَالٰی এর জন্য নির্দিষ্ট ছিলো হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে ক্বিবলা করা হয়েছিলো মাত্র। সুতরাং হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) ছিলেন مَسجُوۡدُ اِلَیۡهِ (যার দিকে সাজদা করা হয়); مَسۡجُوۡدُ لَهٗ (যাঁর উদ্দেশ্যে সাজদা করা হয়) নন।” কিন্তু এ অভিমত দুর্বল। কেননা, এ সাজদা দ্বারা হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) (আমাদের নাবী ও এ নাবীর উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য ছিলো। আর (যাঁর দিকে সাজদা করা হয় অর্থাৎ ক্বিবলা) সাজদাকারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যেমন, কা’বা মু‘আয্যামাহ্ সৈয়্যদে আম্বিয়া صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর ক্বিবলা ও مَسجُوۡدُ اِلَیۡهِ ; অথচ হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কা’বা থেকেও শ্রেষ্ঠ।
অন্য অভিমত হলো- এখানে ‘সাজদা-ই-ইবাদত’ ছিলো না; বরং ‘সাজদা-ই-তাহিয়্যাহ’-ই ছিলো। আর ঐ সাজদা শুধু হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর জন্যই ছিলো। মাটির উপর কপাল রেখেই তা করা হয়েছিলো; শুধু মাথা নত করে নয়। এটাই সঠিক ও অধিকাংশের অভিমত। (মাদারিক)
মাসআলাঃ ‘সাজদা-ই-তাহিয়্যাহ’ (বা সম্মান প্রদর্শনার্থে সাজদা) পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহে জায়েয ছিলো। আমাদের শরীয়তে রহিত (মানসূখ) হয়ে গেছে। এখন কারো জন্য তা জায়েয নয়। কেননা, যখন হযরত সালমান رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُহুযূর আক্বদাস صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -কে সাজদা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, তখন হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم ইরশাদ ফরমালেন, “মাখ্লূকের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সাজদা করা উচিত নয়।” (মাদারিক)।
ফিরিশতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সাজদাকারী হলেন- হযরত জিবরাঈল অতঃপর হযরত মীকাঈল, অতঃপর হযরত ইস্রাফীল, অতঃপর হযরত আয্রাঈল, অতঃপর আল্লাহর নৈকট্যধন্য ফিরিশ্তাগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) এ সাজদা জুমু‘আর দিন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলার সময় থেকে ‘আসর’ পর্যন্ত হয়েছিলো। এক অভিমত এটাও আছে যে, আল্লাহর নৈকট্যধন্য ফিরিশ্তারা একশ’ বছর, আর অন্য অভিমতে, পাঁচশ বছর সাজদারত ছিলেন। (কিন্তু) শয়তান সাজদা করেনি এবং সে অহংকারবশতঃ এ বিশ্বাসই পোষণ করতে থাকে যে, সে হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) থেকেও শ্রেষ্ঠ। তাকে সাজদার নির্দেশ দেয়া হিকমতের পরিপন্থী। (মা‘আযাল্লাহি ٰتَعَالٰی) এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে সে কাফির হয়ে গেছে।
মাসআলাঃ আয়াত শরীফে এ কথার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) ফিরিশতাকুল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ কারণেই তাঁকে তাঁদের দ্বারা সাজদা করানো হয়েছে।
মাসআলাঃ অহংকার অতীব মন্দ। এতে কখনো অহংকারী ব্যক্তির কার্যকলাপ ‘কুফর’ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। (বায়দাভী ও জুমাল)
আয়াত নং- ৩৫
________
অনুবাদ:
৩৫ঃ এবং আমি ইরশাদ করলাম, ‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী এ জান্নাতে অবস্থান করো এবং খাও এখানে কোন বাধা-বিঘ্ন ব্যতিরেকেই, যেখানে তোমাদের মন চায়; কিন্তু এ গাছের নিকটেও যেওনা (৬২) গেলে, (তোমরা) সীমা অতিক্রমকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে(৬৩)।’
________
টীকা-৬২ঃ এটা দ্বারা গম কিংবা আঙ্গুর ইত্যাদি গাছের কথা বুঝানো হয়েছে। (জালালাইন)
টীকা-৬৩ঃ ‘ ظُلۡمٌ ’ (যুলুম) শব্দের অর্থ হচ্ছে কোন বস্তুকে অনুপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা। এটা নিষিদ্ধ। আর নাবীগণ হলেন- ‘মা’সুম বা নিষ্পাপ। তাঁদের দ্বারা গুনাহ সম্পাদিত হয়না। (সুতরাং) এখানে ‘যুলম' (ظُلۡمٌ) মানে হচ্ছে- ‘অধিকতর উত্তম কাজের পরিপন্থী মাত্র (خِلَافِ اَوۡلٰی) নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) -কে ‘যালিম’ বলা তাঁদের অবমাননা করার শামিল এবং কুফর। যে কেউ এরূপ বলবে সে কাফির হয়ে যাবে। আল্লাহ্ تَعَالٰی মালিক ও মুনিব। তিনি যা চান ইরশাদ করেন। এতে তাঁর ইজ্জত ও মহত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অন্যের কি অবকাশ আছে যে, সে আদব বা শালীনতা-বিবর্জিত কথা মুখে উচ্চারণ করবে এবং আল্লাহর ‘সম্বোধন’কে স্বীয় দুঃসাহসের জন্য সনদ বানাবে? (আল্লাহ্) আমাদেরকে তাঁদের (নাবীগণ) সম্মান, আদব ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের উপর এটাই অপরিহার্য।
আয়াত নং- ৩৬
________
অনুবাদ:
৩৬ঃ অতঃপর শয়তান জান্নাত থেকে তাদের পদস্খলন ঘটালো এবং যেখানে ছিলো সেখান থেকে তাদেরকে আলাদা করে দিলো (৬৪)। আর আমি ইরশাদ করলাম, ‘(তোমরা) নিচে নেমে যাও (৬৫)! তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু; এবং তোমাদেরকে একটা (নির্দ্ধারিত) সময়সীমা পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান ও জীবিকা অবলম্বন করতে হবে (৬৬)।’
________
টীকা-৬৪ঃ শয়তান কোন মতে, হযরত আদম ও হাওয়া (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) -এর নিকট পৌঁছে বললো, “আমি কি আপনাদের ‘শাজরাতুল খুলদ’ বা এমন একটা গাছের কথা বলবো, যার ফল আহার করলে জান্নাতে চিরস্থায়ী হওয়া যায়? হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সে (শয়তান) তখন শপথ করে বললো,“আমি আপনাদের হিতাকাঙ্খী।” তাঁদের ধারণা ছিলো আল্লাহ্ পাকের নাম নিয়ে মিথ্যা শপথ কে করতে পারে? সুতরাং এ ধারণার ভিত্তিতে হযরত হাওয়া (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) সেই গাছের কিছু ফল আহার করলেন অতঃপর হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে দিলেন। তিনিও আহার করলেন। হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর ধারণা ছিলো যে, لَا تَقۡرَبَ (তোমরা ঐ গাছের কাছে যেওনা!) -এর নিষেধটা تَنۡزِیۡهِی (মাকর“হে তানযীহি) নির্দেশক, تَحۡرِیۡمِی বা ‘হারাম নির্দেশক’ নয়। কেননা, তিনি যদি তা ‘হারাম’ জ্ঞাপক’ মনে করতেন, তবে কখনো এরূপ করতেন না। কেননা, নাবীগণ মা’সূম বা নিষ্পাপ। এখানে হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর ইজতিহাদ (সত্য সন্ধানে চরম প্রচেষ্টা) -এ ত্রুটি হয়েছে মাত্র এবং ‘ইজতিহাদ’-এ ত্রুটি হলে নির্দেশ অমান্য জনিত কোন গুনাহ্ হয়না।
টীকা-৬৫ঃ হযরত আদম ও হাওয়া (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) এবং তাঁদের বংশধরগণকে; যারা তাঁদের ঔরসে ছিলো, জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নেমে আসার নির্দেশ দেয়া হলো। হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) চরন্দ্বীপের (শ্রীলংকা) পর্বতমালার উপর এবং হযরত হাওয়া (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) জিদ্দায় অবতীর্ণ হন। (খাযিন)
হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর বরকতে পৃথিবীর গাছসমূহে পবিত্র খুশবু সৃষ্টি হলো। (রূহুল বয়ান)
টীকা-৬৬ঃ এ থেকে বয়সের শেষ সময় অর্থাৎ মৃত্যুর মুহূর্তের কথাই প্রতিভাত হয়। আর হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর জন্য এ সুসংবাদই রয়েছে যে, তাঁকে দুনিয়াতে শুধু এতটুকু সময়ের জন্য বসবাস করতে হবে। অতঃপর পুনরায় তিনি জান্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং তাঁর বংশধরদের জন্যও তাদের পরকালের সংবাদ রয়েছে। অর্থাৎ তাদের পার্থিব জীবন সীমিত সময়ের জন্য। তাদের জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তাদেরকে পুনরায় পরকালের দিকে ফিরে যেতে হবে।
আয়াত নং- ৩৭
________
অনুবাদ:
৩৭ঃ অতঃপর শিখে নিলেন আদম আপন প্রতিপালকের নিকট থেকে কিছু কলেমা (বানী)। তখন আল্লাহ তাঁর তাওবা কবূল করলেন (৬৭)। নিশ্চয় তিনিই অত্যন্ত তাওবা কবূলকারী, দয়ালু।
________
টীকা-৬৭ঃ হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) পৃথিবীতে আসার পর তিনশত বছর পর্যন্ত লজ্জায় আসমানের দিকে মাথা উঠান নি। যদিও হযরত দাঊদ (عَلَیۡهِ السَّلَام) অধিক ক্রন্দনকারী ছিলেন; তাঁর অশ্রু সমস্ত দুনিয়াবাসীর অশ্রু অপেক্ষাও অধিক ছিলো, কিন্তু হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এত বেশি ক্রন্দন করেছিলেন যে, তাঁর চোখের পানির পরিমাণ হযরত দাঊদ (عَلَیۡهِ السَّلَام) সহ সমস্ত দুনিয়াবাসীর চোখের পানির পরিমাণ অপেক্ষাও অধিক হয়েছিলো। (খাযিন)
ইমাম তাবরানী, হাকিম, আবূ না‘ঈম এবং বায়হাক্বী প্রমূখ হযরত আলী মুরতাদা رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُ থেকে হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর সূত্রে (مَرۡفُوۡعًا) বর্ণনা করেছেন যে, যখন হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর এ কাজের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করা হলো তখন তিনি তাওবার চিন্তায় অস্থির ছিলেন। দুশ্চিন্তার এ অবস্থায় তাঁর স্মরণ হলো- “সৃষ্টির সন্ধিক্ষণে আমি মাথা উঠিয়ে দেখেছিলাম, আরশের উপর লিখা আছে لَا اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوۡلُ اللّٰه ; আমি বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ্ تَعَالٰی -এর দরবারে সেই উন্নত মর্যাদা অন্য কারো ভাগ্যে জোটেনি যা হযরত মুহাম্মদ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে প্রদান করা হয়েছে। কেননা, আল্লাহ্ تَعَالٰی তাঁর পবিত্র নাম স্বীয় বরকতময় নামের সাথে আরশের উপর লিপিবদ্ধ করেছেন।” অতএব, তিনি (হযরত আদম عَلَیۡهِ السَّلَام) স্বীয় প্রার্থনায় رَبّنَا ظَلَمۡنَآ الآیة (রাব্বানা যলামনা-আল-আয়াত) পাঠ করে এ প্রার্থনা করেছিলেন- '' اَسۡئَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ اَنۡ تَغۡفِرَلِیۡ"
(অর্থাৎ হে প্রতিপালক! আমি আপনার নিকট হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এরই ওসীলায় ক্ষমা প্রার্থনা করছি।) হযরত ইবনে মুনরের বর্ণনায় এ বাক্যের উলে−খ রয়েছে- অর্থাৎ اَللّٰهُمَّ اِنِّیۡ اَسۡئَلُكَ بِجَاهِ مُحَمَّدٍ عَبۡدِكَ وَكَرَامَتِهٖ عَلَیۡكَ اَنۡ تَغۡفِرَلِیۡ خَطِیۡئَتِیۡ “হে প্রতিপালক! আমি আপনার নিকট আপনার খাস বান্দা মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর মহা মর্যাদার ওসীলায় এবং তাঁর সম্মানের মাধ্যমে, যা আপনার দরবারে রয়েছে, ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” এ প্রার্থনা করা মাত্রই আল্লাহ্ تَعَالٰی তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন।
মাসআলাঃ এ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর দরবারে মাক্ববূল বান্দাদের ওসীলা বা মাধ্যম সহকারে, যেমন بِحَقِّ فُلَانٍ ٫ بِجَاهِ فُلَانٍ (অমুকের ওসীলার বা মাধ্যমে) দুআ’ করা জায়েয এবং হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর সুন্নাত (ত্বরীকা)।
মাসআলাঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی এর উপর কারো হক্ব বা প্রাপ্য ওয়াজিব হয় না। কিন্তু তিনি আপন মাক্ববূল বান্দাদেরকে স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা তাঁদের হক বা প্রাপ্য দান করেন। এ ‘অনুগ্রহময় হক এর ওসীলা নিয়ে প্রার্থনা করা যায়। বিশুদ্ধ হাদীস শরীফসমূহ সূত্রেই এ ‘হক’ প্রমাণিত। যেমন, হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- مَنۡ اٰمَنَ بِا اللّٰهِ وَرَسُوۡلِهٖ وَاَقَامَ الصَّلٰوةَ وَصَامَ رَمَضَانَ كَانَ حَقًا عَلٰی اللّٰهِاَنۡ یُدۡخِلُهُ الۡجَنَّةَ অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর এবং তাঁর রসূলের উপর ঈমান এনেছে, নামায ক্বায়েম করেছে, অতঃপর রমযানের রোযা পালন করেছে, তার জন্য আল্লাহর কৃপায় এ হক্বই নির্ধারিত হয়ে গেলো যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।)
হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর তাওবা ১০ই মুহাররম ক্ববুল হয়েছিল। জান্নাত থেকে বের করার সময় অন্যান্য নি‘মাত বা অনুগ্রহের সাথে সাথে আরবী ভাষাও তাঁর নিকট থেকে লুপ্ত করা হয়েছিলো। তখন আরবীর পরিবর্তে তাঁর বরকতময় মুখে ‘সুরিয়ানী’ ভাষা জারী করা হয়। তাওবা ক্ববুল হওয়ার পর পুনরায় তাঁকে আরবী ভাষা প্রদান করা হয়। (ফত্হুল আযীয)
মাসআলাঃ তাওবার মূল অর্থ- ‘আল্লাহর প্রতি ফিরে আসা।’ এর তিনটি মৌলিক উপাদান রয়েছে- (১) স্বীয় অপরাধ স্বীকার করা, (২) তজ্জন্য লজ্জিত হওয়া এবং (৩) তা পরিহার করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা। গুনাহ্ যদি প্রতিকারযোগ্য হয় তবে প্রতিকার করাও বাঞ্ছনীয়। উদাহরণ স্বরূপ, নামায পরিত্যাগকারীর তাওবার জন্য বিগত নামাযসমূহের কাযা দেয়াও জরুরী।
তাওবার পরক্ষণে হযরত জিবরাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) পৃথিবীর সমস্ত জীব-জন্তুর উদ্দেশ্যে আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর খিলাফতের ঘোষণা দিলেন এবং সবার উপর তাঁর আনুগত্য অপরিহার্য হবার হুকুম শুনিয়ে দিলেন। সবাই তাঁর আনুগত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলো। (ফত্হুল আযীয)
আয়াত নং- ৩৮
________
অনুবাদ:
৩৮ঃ আমি ইরশাদ করলাম তোমরা সবাই জান্নাত থেকে নেমে যাও! অতঃপর পরে যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত আসে, তবে যে ব্যক্তি আমার সেই হিদায়তের অনুসারী হবে, তার জন্য না কোন ভয়, (এবং) না কোন দুঃখ থাকবে (৬৮)।
________
টীকা-৬৮ঃ এটা নেক্কার মু’মিনদের জন্য সুসংবাদ। অর্থাৎ না তাঁদের মহাপ্রলয়ের দিনে কোন ভয় থাকবে, না আখিরাতের কোন দুঃখ (থাকবে)। তাঁরা নিশ্চিন্তে বেহেশতে প্রবেশ করবেন।
আয়াত নং- ৩৯
________
অনুবাদ:
৩৯ঃ আর সে সব লোক, যারা কুফর করবে এবং আমার নির্দেশগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তারা হলো দোযখবাসী, তাদেরকে সেখানেই সর্বদা থাকতে হবে।
আয়াত নং- ৪০
________
অনুবাদ:
৪০ঃ হে য়া’কুবের বংশধরগণ (৬৯)! (তোমরা) স্মরণ করো আমার ঐ অনুগ্রহকে, যা আমি তোমাদের উপর করেছি (৭০) এবং আমার অঙ্গীকার পূরণ করো। আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করবো (৭১) এবং বিশেষ করে, আমারই ভয় (অন্তরে) রাখো(৭২)
________
টীকা-৬৯ঃ ‘ইসরাঈল’ অর্থ ‘আ’ব্দুল্লাহ’ (আল্লাহর বান্দা); হিব্র“ (عبری) ভাষার শব্দ। এটা হযরত য়া’কূব (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর উপাধি। (মাদারিক)।
তাফসীরকারক কালবী বলেছেন, আল্লাহ্ تَعَالٰی বলেছেন, یٰآَیُّهَا النّاسُ اعۡبُدُوۡا (অর্থাৎ হে মানব জাতি! তোমরা ইবাদত করো.......) ইরশাদ করে প্রথমে সমস্ত মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। তারপর اِذۡ قَالَ رَبُّكَ (স্মরণ করুন! যখন আপনার প্রতিপালক ইরশাদ করেছেন) ইরশাদ করে তাদের প্রারম্ভিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর বিশেষভাবে বনী ইস্রাঈলকে আহ্বান করেছেন।
এরা হচ্ছে ইহুদী সম্প্রদায় আর এখান থেকে سَیَقُوۡلُ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কে বর্ণনা অব্যাহত রয়েছে। কখনো দয়ার সুরে পুরস্কারের কথা স্মরণ করিয়ে (সত্যের দিকে) আহ্বন করা হয়, কখনো ভীতি প্রদর্শন করা হয়, কখনো প্রমাণ দাঁড় করানো হয়, কখনো তাদের অপকর্মের জন্য তিরস্কার করা হয়, আবার কখনো পূর্ববর্তী বিভিন্ন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়।
টীকা-৭০ঃ এ অনুগ্রহ যে, তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে ফিরআউন থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সাগর ফাঁক করেছেন এবং মেঘকে ছায়াদানকারী করেছেন। তাছাড়া, অন্যান্য অনুগ্রহরাজি, যেগুলোর বর্ণনা সামনে আসছে, সেগুলো স্মরণ করো! ‘স্মরণ করা’র মানে হচ্ছে- ‘আল্লাহ্ تَعَالٰی' এর আনুগত্য ও বন্দেগীর মাধ্যমে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করাই সে নি‘মাতকে ভুলে যাবার নামান্তর মাত্র।
টীকা-৭১ঃ অর্থাৎ তোমরা ঈমান ও আনুগত্য বজায় রেখে আমার অঙ্গীকার পূরণ করো, (ফলতঃ) আমি প্রতিদান ও সাওয়াব দান করে তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করবো। সে অঙ্গীকারের বর্ণনা নিম্নলিখিত আয়াতে রয়েছে- وَلَقَدۡ اَخَذَاللّٰهُ مِیۡثٰقَ بَنِیۡٓ اِسۡرَآءیۡلَ অর্থাৎ এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ تَعَالٰی বানী ইসরাঈল সম্প্রদায় থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন।)
টীকা-৭২ঃ মাসআলাঃ এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ্ تَعَالٰی এর নি‘মাতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং অঙ্গীকার পূরণ করা অপরিহার্য হবার বর্ণনা রয়েছে। এ কথারও যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুকে ভয় করা মু’মিনের উচিত নয়।

0 মন্তব্যসমূহ