তাফসীরে কুরআন - ৫

  

তাফসীরে কুরআন ৫  সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৪১-৫০  (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

 সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৪১-৫০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

আয়াত নং- ৪১

________


অনুবাদ:


৪১ঃ এবং (তোমরা) ঈমান আনো সেটার উপর, যা আমি অবতীর্ণ করেছি সেটারই সমর্থকরূপে যা তোমাদের সাথে আছে এবং সর্বপ্রথথম সেটার অস্বীকারকারী হয়ো না (৭৩)। আর আমার আয়াতগুলোর বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না (৭৪) এবং শুধু আমাকেই ভয় করো।

________


টীকা-৭৩ঃ অর্থাৎ ক্বুরআন পাক, তাওরীত এবং ইঞ্জীলের উপর, যেগুলো তোমাদের সাথে রয়েছে, ঈমান আনো এবং কিতাবীদের মধ্যে প্রথম কাফির হয়োনা, যেন তোমাদের অনুসরণ করে যারা ‘কুফর’ অবলম্বন করবে তাদের শাস্তিও তোমাদের উপর না বার্তায়। 


টীকা-৭৪ঃ এ সব আয়াত দ্বারা তাওরীত ও ইঞ্জীলের ঐসব আয়াতের কথা বুঝানো হয়েছে, যে গুলোতে হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর না’ত (প্রশংসা) ও গুনাবলীর বর্ণনা রয়েছে। অর্থাৎ হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর প্রশংসা পার্থিব ধন-দৌলতের লিপ্সার বশীভূত হয়ে গোপন করো না। কেননা, পার্থিব মাল-দৌলত নগণ্য মূল্যস্বরূপ এবং আখিরাতের মুকাবিলায় অতি তুচ্ছ।


শানে নুযুলঃ এ আয়াত শরীফ কা‘আব ইবনে আশরাফ এবং ইহুদী সম্প্রদায়ের অন্যান্য আ’লিম(!) ও নেতৃবৃন্দের প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা স্বীয় সম্প্রদায়ের মূর্খ ও নিম্নশ্রেণীর লোকদের নিকট থেকে টাকা-পয়সা উশুল করে নিতো এবং তাদের উপর বার্ষিক কর নির্ধারণ করতো। আর তারা উৎপাদনের ফলমূল ও নগদ টাকায়ও নিজেদের ‘প্রাপ্য’ (?) নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলো। তারা এ আশঙ্কা বোধ করেছিলো যে, তাওরীত শরীফে হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর যে প্রশংসা ও গুণাাবলীর উল্লেখ রয়েছে সেগুলো যদি তারা প্রকাশ করে দেয়, তবে তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর উপর ঈমান এনে বসবে এবং তাদের আর কোন খোঁজ খবর নেয়া হবেনা। আর এ সব সুযোগ সুবিধাও তারা হারাতে থাকবে। এ জন্য তারা তাদের কিতাবগুলোতে পরিবর্তন করলো এবং হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর প্রশংসা জ্ঞাপক বাক্যগুলো বদলে ফেললো। যখন তাদেরকে লোকেরা জিজ্ঞেস করতো- ‘তাওরীতে হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর কি কি গুণাবলীর উল্লেখ আছে!’ 


তখন তারা সেগুলো গোপন করে বসতো এবং কখনো কিছুই বলতো না। এ প্রসঙ্গে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে। (খাযিন ইত্যাদি)



আয়াত নং- ৪২

________


অনুবাদ:


৪২ঃ এবং সত্যের সাথে বাতিলকে মিশ্রিত করো না ও দেখে-জেনে সত্যকে গোপন করোনা।



আয়াত নং- ৪৩

________


অনুবাদ:


৪৩ঃ এবং নামায কায়েম রাখো ও যাকাত দাও এবং যারা রুকূ-’ করে তাদের সাথে রুকূ করো (৭৫)।

________


টীকা-৭৫ঃ এ আয়াতে নামায ও যাকাত ফরয হবার বর্ণনা রয়েছে। আর এ দিকেও ইঙ্গিত রয়েছে যে. নামায সমূহ সেগুলোর করণীয় বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ‘আরকান’ বা মৌলিক কার্যাদি যথাযথভাবে পালন করে, সম্পন্ন করো! 


মাসআলাঃ (এতে) জামা‘আতের প্রতিও উৎসাহিত করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- জামা‘আতের সাথে নামায পড়া একাকী পড়ার চাইতে সাতশগুণ অধিক ফযীলত রাখে।



আয়াত নং- ৪৪

________


অনুবাদ:


৪৪ঃ তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দিচ্ছো এবং নিজেদের আত্মাগুলোকে ভুলে বসছো? অথচ তোমরা কিতাব পড়ছো। তবুও কি তোমাদের বিবেক নেই (৭৬)?

________


টীকা-৭৬ঃ শানে নুযুলঃ ইহুদী সম্প্রদায়ের আ’লিমদের (!) নিকট তাদের মুসলিম আত্মীয়-স্বজনেরা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তারা বললো, “তোমরা সে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো! হুযূর সৈয়্যদে আ’লম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর দ্বীন সঠিক এবং তাঁর বাণী সত্য।” এর পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে। 


অন্য এক অভিমত হলো- এ আয়াত শরীফ ঐসব ইহুদীর প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে, যারা আরবের মুশরিকদের (অংশীবাদীগণ )-কে হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছিলো এবং হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর অনুসরণ করার প্রতি হিদায়াত করেছিলো। অতঃপর যখন হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم প্রেরিত হলেন তখন এসব হিদায়াতকারী নিজেরাই হিংসার বশীভূত হয়ে কাফির হয়ে গেলো। এ জন্য তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। (খাযিন ও মাদারিক)



আয়াত নং- ৪৫

________


অনুবাদ:


৪৫ঃ এবং ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। এবং নিশ্চয় নামায অবশ্যই ভারী, কিন্তু তাদের জন্য (নয়), যারা আন্তরিকভাবে আমার প্রতি বিনীত হয় (৭৭):

________


টীকা-৭৭ঃ অর্থাৎ প্রয়োজন বা সমস্যার ক্ষেত্রে ধৈর্য এবং নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। সুব্হানাল্লাহ! কেমন পবিত্র শিক্ষা। ‘সবর’ (ধৈর্য) সব মুসীবতের চরিত্রগত মুকাবিলা; এটা ছাড়া মানুষ ন্যায় বিচার, দৃঢ়তা ও সত্যপরায়নতার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। 


সবরঃ সবর তিন প্রকার। যথাঃ (১) কঠিন বিপদে নিজেকে স্থির রাখা, (২) ইবাদত-বন্দেগীর কষ্ট অটলভাবে সহ্য করা এবং (৩) গুনাহের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে নিজ সত্তাকে বিরত রাখা। কোন কোন মুফাসসির এখানে উল্লেখিত ‘সবর’- এর অর্থ রোযা বলেও অভিমত প্রকাশ করেছেন। কারণ, এটাও সবরের পর্যায়ভুক্ত। 


এ আয়াতে বিপদের সময় নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কেননা, তা (নামায) শারীরিক ও আত্মিক উভয় প্রকার ইবাদতেরই ধারক। 


আর এতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্মুখে উপস্থিত হলে নামাযে মশগুল হয়ে যেতেন। 


এ আয়াতে একথাও বলা হয়েছে যে, সত্যনিষ্ঠ মু’মিনগণ ব্যতীত অন্যান্যদের উপর নামায কঠিন কাজ।



আয়াত নং- ৪৬

________


অনুবাদ:


৪৬ঃ যাদের অন্তরে এ দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, তাদের আপন প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে এবং তাঁরই দিকে যেতে হবে (৭৮)।

________


টীকা-৭৮ঃ এ আয়াতে সুসংবাদ রয়েছে যে, আখিরাতে মু’মিনগণ আল্লাহর দীদার বা সাক্ষাৎরূপী নি’মাত লাভ করবেন।



আয়াত নং- ৪৭

________


অনুবাদ:


৪৭ঃ হে য়া’কুবের বংশধরগণ! স্মরণ করো, আমার সেই অনুগ্রহকে যা আমি তোমাদের উপর করেছি। আর এ কথাও যে, আমি এ সমগ্র যুগের উপর তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি(৭৯)।

________


টীকা-৭৯ঃ (এখানে) اَلۡعٰلَمِیۡنَ 


(আল্-‘আলামীন) এর ব্যাপকতা (استغراق) প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত নয়। (অর্থাৎ-বনী ইস্রাঈলের শ্রেষ্ঠত্ব পৃথিবীর, সৃষ্টির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, সবার উপর নয়; বরং) এর অর্থ হচ্ছে- (আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেছেন, “হে বানী ইসরাঈল!) আমি তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে তাদের যুগের সবার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” 


অথবা আয়াতে আংশিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে, যাতে অন্য কোন উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করা না হয়। এ জন্যই উম্মতে মুহাম্মদীর প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে- অর্থাৎ كُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّةٍ “তোমরা শেষ্ঠতম উম্মত।” (রুহুল বয়ান ও জুমাল ইত্যাদি)



আয়াত নং- ৪৮

________


অনুবাদ:


৪৮ঃ এবং ভয় করো ঐ দিনকে, যেদিন কোন আত্মা অন্য কারো বিনিময় হতে পারবে না (৮০) এবং না (কাফিরদের পক্ষে) কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে এবং না কোন কিছু নিয়ে (তার) আত্মাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং না তারা কোন প্রকার সাহায্য পাবে (৮১)।

________


টীকা-৮০ঃ সেটা হলো রোজ ক্বিয়ামত। আয়াতের মধ্যে (আত্মা) - এর দ্বারা মু’মিনদের ‘নাফস’ এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা কাফিরদের ‘নাফস’ বুঝানো হয়েছে। (মাদারিক)


টীকা-৮১ঃ এখান থেকে রুকূ’র শেষ পর্যন্ত দশটা অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো বর্তমানকার বানী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের পিতৃপুরুষগণ লাভ করেছিলো।



আয়াত নং- ৪৯

________


অনুবাদ:


৪৯ঃ এবং (স্মরণ করো!) আমি তোমাদেরকে ফিরআউনী সম্প্রদায় থেকে নিষ্কৃতি দান করেছি (৮২), যারা তোমাদেরকে মর্মান্তিক যন্ত্রনা দিতো (৮৩); তোমাদের পুত্রদেরকে যবেহ করতো আর তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো (৮৪); এবং এর মধ্যে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক মহা ‘বালা’ ছিলো (অথবা মহা পুরস্কার) (৮৫)।

________


টীকা-৮২ঃ ‘ক্বিবতী’ ও ‘আমালীক্ব’ সম্প্রদায় থেকে যে-ই মিশরের বাদশাহ্ হয়েছিলো তাকেই ‘ফিরআউন’ বলা হয়। হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام)-এর যুগের ফিরআউন নাম ‘ওয়ালিদ ইবনে মাস্‘আব ইবনে রাইয়্যান’ ছিলো। এখানে তারই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার বয়স চারশ বছরেরও অধিক ছিলো। আর ‘আল-ই-ফিরআউন’ বলে ফিরআউনের অনুসারীদের কথা বুঝানো হয়েছে। (জুমাল ইত্যাদি) 


টীকা-৮৩ঃ ‘আযাব’ (যন্ত্রনা) তো সবই মন্দ (মর্মান্তিক) হয়ে থাকে (আয়াতে) (سُوۡٓءَ الۡعَذَابِ) মর্মান্তিক যন্ত্রনা) বলে সেটাই বুঝানো হয়েছে, যা অন্যান্য যন্ত্রনা অপেক্ষা অধিকতর কঠিন ও মর্মান্তিক হবে। এজন্যই হযরত অনুবাদক (আ’লা হযরত ক্বুদ্দিসা সিররুহু) ‘برا عذاب’ (মর্মান্তিক যন্ত্রনা) অনুবাদ করেছেন। (যেমন- তাফসীর-ই-জালারায়ন শরীফ ইত্যাদিতে রয়েছে।) 


ফিরআউন বনী-ইস্রাঈল (সম্প্রদায়)- এর উপর অত্যন্ত নির্দয়ভাবে, কঠোর পরিশ্রম ও কষ্টকর কার্যাদি চাপিয়ে দিয়েছিলো। কঙ্গকরময় ভূমি কেটে মাটি বহন করতে করতে তাদের কোমর ও কাঁধ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। গরীবদের উপর ‘কর’ (Tax) আরোপ করেছিলো, যা প্রত্যহ সূর্যাস্তের পূর্বেই জোরপূর্বক উশুল করে নেয়া হতো। আরো নানা ধরণের নির্দয় নিপীড়ন চালানো হতো। (খাযিন ইত্যাদি) 


টীকা-৮৪ঃ ফিরআউন স্বপ্নে দেখলো- ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’ -এর দিক থেকে আগুন এসে সমগ্র মিশরকে অবরোধ করে সমস্ত ক্বিবতী (ফিরআউনের সমর্থকগণ)-কে জ্বালিয়ে দিলো। বনী ইসরাঈলের কোন ক্ষতি করলো না। এর ফলে তার মনে মহা আতঙ্কের সঞ্চার হলো। গণকগণ এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে বললো, “বনী ইসরাঈলে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, যে আপনার এবং আপনার সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হবে।” এটা শুনে ফিরআউন নির্দেশ দিলো-‘বনী ইসরাঈলে যে সস্তান জন্মগ্রহণ করবে তাকে হত্যা করা হোক।’ অনুসন্ধানের জন্য বহু ধাত্রী নিয়োগ করা হলো। বারো হাজার, অন্য বর্ণনা মতে, সত্তর হাজার নবজাতককে হত্যা করা হলো। আর নব্বই হাজার গর্ভপাত ঘটানো হলো। 


আল্লাহর ইচ্ছায়, তখন এ সম্প্রদায়ের (বানী ইসরাঈল) বৃদ্ধ লোকের দ্রুত মৃত্যুবরণ করতে লাগলো। ক্বিবতী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ ভীত হয়ে ফিরআউনের নিকট অভিযোগ করলো, “বর্তমানে বনী-ইসরাঈলে মৃত্যুর হার খুব বৃদ্ধি পেয়েছে। তদুপরি, তাদের শিশুদেরকেও হত্যা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে আমরা সেবক পাবো কোথায়?” সুতরাং ফিরআউন নির্দেশ দিলো, ‘এক বৎসর শিশু হত্যা করা হবে এবং এক বৎসর হত্যা মওকূফ থাকবে।’ অতঃপর যে বৎসর হত্যা মাওকূফ ছিলো সে বৎসর হযরত হারূন (عَلَیۡهِ السَّلَام) জন্মগ্রহণ করলেন। আর যে বৎসর পুনঃহত্যা চালু হলো সেই বৎসরই হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام)- এর জন্ম হলো। 


 টীকা-৮৫ঃ ‘বালা’ পরীক্ষা করাকেই বলা হয়। পরীক্ষা যেমন অনুগ্রহ দ্বারা করা হয়, তেমনি কষ্ট ও পরিশ্রম দ্বারাও। অনুগ্রহ-প্রাপ্তির সময় বান্দার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং মুসীবতের সময় তার ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যদি ذٰلِکُمۡ দ্বারা ইঙ্গিত ফিরআউনের অত্যাচারগুলোর প্রতি হয়, তবে ‘বালা’ মানে হবে-‘পরিশ্রম’ ও ‘বিপদ’; আর যদি ঐসব নিপীড়ন থেকে নিষ্কৃতি প্রদানের প্রতি হয় তবে ‘বালা’ মানে হবে ‘পুরস্কার’।



আয়াত নং- ৫০

________


অনুবাদ:


৫০ঃ এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিধা-বিভক্ত (ফাঁক) করেছি, অতঃপর তোমাদেরকে রক্ষা করেছি। আর ফিরআউনী সম্প্রদায়কে তোমাদের চোখের সামনে ডুবিয়ে দিয়েছি (৮৬)

________


টীকা-৮৬ঃ এটা দ্বিতীয় অনুগ্রহের বর্ণনা, যা বনী ইসরাঈলের উপর করেছেন- তাদেরকে ফিরআউনী সম্প্রদায়ের যুলুম-অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন এবং ফিরআউনকে তার সম্প্রদায়সহ তাদের সামনে ডুবিয়ে মেরেছেন। এখানে ‘আল-ই-ফিরআউন’ মানে ‘ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়’ যেমন, (আয়াতাংশ ‘كَرَّمۡنَا بَنِیۡٓ اٰدَمَ’ (কাররমনা বানী আ-দামা) - এর মধ্যে হযরত আদম (عَلَیۡهِ السَّلَام) ও আদম-সন্তানগণ উভয়ই শামিল রয়েছে। (জুমাল) 


সংক্ষিপ্ত ঘটনাঃ হযরত মূসা  عَلَیۡهِ الصَّلٰوةُ وَالسَّلَام আল্লাহর নির্দেশক্রমে, রাত্রি বেলায় বানী ইসরাঈলকে নিয়ে মিশর থেকে রওয়ানা দিলেন। 


ভোরে ফিরআউন তাদের তালাশে এক বিরাট সেনা-বাহিনীসহ অগ্রসর হলো এবং তাঁদেরকে সাগরের তীরে গিয়ে পেয়েছিলো। বানী ইসরাঈল ফিরআউনের সৈন্যদের দেখে হযরত মূসা عَلَیۡهِ السَّلَام নিকট ফরিয়াদ করলো। তিনি আল্লাহর নির্দেশে সাগরে স্বীয় ‘লাঠি’ দ্বারা আঘাত করলেন। এর বরকতে মূল সাগরে বারোটা শুষ্ক রাস্তা তৈরি হয়ে গেলো। পানি দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেলো। সেই পানির দেয়ালসমূহে জালির ন্যায় আলোকময় ছিদ্রের সৃষ্টি হলো। বনী-ইসরাঈলের প্রতিটি গোত্র ওসব রাস্তায় একে অপরকে দেখতে পেতো এবং পরস্পর কথোপকথন করতে করতে সাগর পার হয়ে গেলো। 


ফিরআউন সাগরে রাস্তা দেখে সেগুলো দিয়ে চলতে আরম্ভ করলো। যখন তার সব সৈন্য সাগরের মাঝখানে নেমে আসলো তখন সাগর আপন অবস্থায় মিলিত হয়ে গেলো। ফলে সমস্ত ফিরআউনী সাগরে ডুবে মারা গেলো। ঐ সাগরের প্রস্থ চার ‘ফরসঙ্গ’ (এক ফরসঙ্গ = ৩ মাইল।) । এ ঘটনাটা ‘বাহরে ক্বুলযম’ - এ ঘটেছিলো; যা পারস্য সাগরের তীরের নিকটে অবস্থিত; কিংবা ‘বাহরে মা-ওয়ারা-ই-মিশর’ এ ঘটেছিলো। ওটা ‘আসাফ’ নামেও খ্যাত। 


বানী ইসরাঈল সাগরের তীরে ফিরআউনীদের নিমজ্জিত হবার ঘটনা স্বচক্ষে দেখছিলো। এ ঘটনা মুহাররমের ১০ তারিখে সংঘটিত হয়। হযরত মূসা عَلَیۡهِ السَّلَام ঐ দিন শোকরিয়ার রোযা রেখেছিলেন। হুযূর সৈয়্যদে আ’লম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এর যমানা পর্যন্ত ইহুদীরা এ দিনে রোযা রাখতো। 


হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -ও এ দিবসে রোযা রেখেছেন। আর ইরশাদ করেছেন, “হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর বিজয়ের খুশী উদ্যাপন এবং এর শোকরিয়া আদায় করার, আমরা ইহুদীদের চেয়েও অধিক হক্বদার।” 


মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা গেলো যে, আশুরার রোযা সুন্নাত। 


মাস্আলাঃ এটাও বুঝা গেলো যে, নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) -এর উপর আল্লাহর যেই অনুগ্রহ হয় তার ‘স্মৃতিস্মারক’ প্রতিষ্ঠা করা এবং শোকর আদায় করা সুন্নাত।


মাসআলাঃ এ কথাও প্রতিভাত হয় যে, এ ধরনের কার্যাদির জন্য তারিখ নির্ধারন করা রসূল কারীম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم -এরই সুন্নাত। 


মাসআলাঃ এ কথাও বুঝা গেলো যে, নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) -এর স্মৃতি যদি কাফিরগণও প্রতিষ্ঠা করতে থাকে তবুও তা বাদ দেয়া যাবে না।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ