তাফসীরে কুরআন - ৬

 

তাফসীরে কুরআন ৬  সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৫১-৬০  (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

 সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৫১-৬০-
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

আয়াত নং- ৫১

________


অনুবাদ:


৫১ঃ এবং যখন আমি মূসাকে চল্লিশ রাতের ওয়াদা দিয়েছিলাম। অতঃপর তার পশ্চাতে (প্রস্থানের পর) তোমরা গো-বৎসের পূজা আরম্ভ করে দিয়েছিলে এবং তোমরা অত্যাচারী ছিলে (৮৭)।

________


টীকা-৮৭ঃ ফিরআউন এবং ফিরআউনের অনুসারীরা ধ্বংস হবার পর যখন হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) বানী ইসরাঈলকে নিয়ে পুনরায় মিশরে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং তাঁর দরখাস্ত মোতাবেক আল্লাহ্ تَعَالٰی তাওরীত প্রদানের ওয়াদা দিলেন এবং তজ্জন্য সময়ও নির্ধারণ করলেন; যার সময়সীমা ছিলো, বর্ধিত সময় সহকারে, একমাস দশদিন-পূর্ণ যিলক্বদ এবং যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন। হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) আপন বড় ভাই হযরত হারূন (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে স্বীয় গোত্রের মধ্যে আপন খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত করে তাওরীত হাসিল করার জন্য ‘তূর পাহাড়’ -এ তাশরীফ নিয়ে গেলেন। চল্লিশ রাত তিনি সেখানে অবস্থান করলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কারো সাথে কথাবার্তা বলেননি। আল্লাহ্ تَعَالٰی ‘যবরজদী লওহ’(জবরজদ প্রস্তর ফলকসমূহ) -এর উপর লিখিত তাওরীত তাঁর প্রতি নাযিল করলেন। 


এ দিকে ‘সামেরী’ স্বর্ণ ও মনিমুক্তা দ্বারা গো-বাছুর (প্রতিমা) তৈরি করে স্বীয় গোত্রের লোকদেরকে বললো, “এটা তোমাদের মা’বুদ বা উপাস্য।”[*বর্ণিত আছে যে, ফিরআউন বনী ইসরাঈলের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে লোহিত সাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছলো। তখন বনী ইসরাঈলের সমুদ্রগর্ভের রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করতে দেখে সে পানিতে ডুবে মারার ভয়ে তাদের অনুসরণ থেকে বিরত রইলো। যেহেতু, আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিলো- তাকে সসৈন্যে পানিতে ডুবিয়ে মারা, সেহেতু, অতঃপর আল্লাহ্ تَعَالٰی একটা ঘুড়ীসহ হযরত জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) -কে মানুষের বেশে প্রেরণ করলেন এবং জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) যখনই তাঁর ঘুড়ী নিয়ে ফিরআউনের সম্মুখ দিয়ে মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর অনুসরণ করলেন তখন ফিরআউনের ঘোড়া হযরত জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর ঘুড়ীর অনুসরণ করলো এবং ফিরআউনের সৈন্যগণও তাকে অনুসরণ করলো। এখানে উল্লেখ্য যে, জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর ঐ ঘুড়ীর কদম যেখানে পড়তো তৎক্ষণাৎ সেখানে ঘাস জন্মাতো। এটা দেখে সামেরী সেখান থেকে কিছু মাটি সংগ্রহ করে সাথে নিয়ে এসেছিলো। এ মাটি সে পরবর্তীতে গো-বৎসরূপী প্রতিমার মুখে যখন রেখেছিলো তখনই সেটার মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হলো এবং গো-বাছুরের মতো শব্দ করে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে আরম্ভ করেছিলো। এটার মাধ্যমে সামেরী বনী ইস্রাঈলকে বিভ্রান্ত করেছিলো।] তারা (গোত্রীয় লোকেরা) দীর্ঘ একমাস যাবৎ হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর জন্য অপেক্ষা করে সামেরীর প্রতারণার শিকার হয়ে গো-বাছুরের পূজা আরম্ভ করে দিলো। হযরত হারূন (عَلَیۡهِ السَّلَام) এবং তাঁর বার হাজার অনুসারী ব্যতীত বানী ইসরাঈল (সম্প্রদায়) -এর বাকী সব লোক ঐ গো-বাছুরের পূজা করেছিলো। (খাযিন)




আয়াত নং- ৫২

________


অনুবাদ:


৫২ঃ অতঃপর এর (এ ঘটনা) পর আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি (৮৮), যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার করো (৮৯)।

________


টীকা-৮৮ঃ তাদেরকে ক্ষমা করার ধরণ ছিলো এরূপ হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) বলেছিলেন, “তাওবার প্রকৃতি এরূপ হবে যে, যারা গো-বাছুরের পূজা করেনি তারা পূজাকারীদেরকে কতল করবে, আর অপরাধকারীরাও স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে ঐ হত্যার শাস্তি গ্রহণ করবে।” তারা এতে রাজি হয়েছিলো। 


সকাল থেকে সন্ধার মধ্যে সত্তর হাজার পূজারী নিহত হলো। তখন হযরত মূসা ও হযরত হারূন (عَلَیۡهِ السَّلَام) অত্যন্ত বিনয় ও কান্না সহকারে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন। ওহী এলো, “যারা নিহত হয়েছে তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করেছে। আর অবশিষ্ট দোষীগণকে ক্ষমা করা হয়েছে। তাদের মধ্যকার হত্যাকারী ও নিহত সবাই জান্নাতি। 


মাসআলাঃ ‘শির্ক’ করলে মুসলমান ‘ধর্মত্যাগী’ (মুরতাদ্দ্) হয়ে যায়। 


মাসআলাঃ ‘মুরতাদ্দ্’ বা ধর্মত্যাগীর শাস্তি হলো- ‘কতল’। কেননা, আল্লাহ্ تَعَالٰی এর সাথে বিদ্রোহ করা হত্যা ও রক্তপাত অপেক্ষাও জঘণ্যতর অপরাধ। 


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ গো-বাছুর তৈরি করে পূজা করার মধ্যে বনী ইসরাঈলে- এর কয়েকট অপরাধ ছিলোঃ (১)মূর্তি তৈরি করা, যা হারাম; ২) হযরত হারূন (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন এবং ৩) গো-বাছুরের পূজা করে মুশরিক হওয়া। ঐসব অপরাধ ফিরআউনী সম্প্রদায় কর্তৃক কৃত অত্যাচার অপেক্ষাও অধিকতর জঘণ্য ছিলো। কেননা, এসব কার্যকলাপ তাদের দ্বারা তাদের ঈমান আনার পরেই সম্পন্ন হয়েছিলো। এ কারণে, তারা এমন শাস্তির উপযোগী ছিলো যে, আল্লাহর শাস্তি তাদেরকে কোন প্রকার অবকাশ দেবে না এবং তাৎক্ষণিক ধ্বংসের কারণে কুফরের উপর জীবনাবসান ঘটবে। কিন্তু হযরত মূসা ও হযরত হারূন (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) এর বদৌলতে তাদেরকে তাওবার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। এটা আল্লাহর এক মহান অনুগ্রহ। 


টীকা-৮৯ঃ এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, বনী ইসরাঈলের কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা ফিরআউনীদের ন্যায় বাতিল হয়নি এবং তাদের বংশ থেকে সৎ ব্যক্তিবর্গের (সালেহীন) জন্ম হবার ছিলো। সুতরাং তাদের মধ্যে হাজার হাজার নাবী (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) ও বুর্যগ (ওলী) জন্ম গ্রহণ করেন।



আয়াত নং- ৫৩

________


অনুবাদ:


৫৩ঃ এবং যখন আমি মূসাকে কিতাব দান করেছি আর হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী, যাতে তোমরা সঠিক পথে এসে যাও।



আয়াত নং- ৫৪

________


অনুবাদ:


৫৪ঃ এবং যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বললো, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বাছুর তৈরি করে নিজেদের আত্মার উপর অবিচার করেছো। সুতরাং তোমরা আপন সৃষ্টিকর্তার দিকে ফিরে এসো। অতঃপর তোমরা একে অপরকে হত্যা করো (৯০)। এটাই তোমাদের স্রষ্টার নিকট তোমাদের জন্য শ্রেয়।’ অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনিই অত্যন্ত তাওবা কবুলকারী, দয়ালু (৯১)।

________


টীকা-৯০ঃ এ ‘কতল’ (হত্যা) তাদের অপরাধের কাফ্ফারা ছিলো। 


টীকা-৯১ঃ যখন বানী ইসরাঈল তাওবা করেছিলো এবং কাফ্ফারা স্বরূপ আপন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলো তখন আল্লাহ্ تَعَالٰی হুকুম করলেন যেন হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) তাদেরকে গো-বাছুরের পূজার অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য হাযির করেন। হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) তাদের মধ্য থেকে সত্তর জন মানুষ নির্বাচিত করে ‘তূর’ পর্বতে নিয়ে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তারা বলতে লাগলো, “হে মূসা! আমরা আপনার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আল্লাহ্কে প্রকাশ্যভাবে দেখবো না।” এর কারণে আসমান থেকে এক ভয়ানক আওয়াজ হলো, যার আতঙ্কে তারা সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) অতীব বিনয় সহকারে (আল্লাহর দরবারে) আরয করলেন, “আমি বানী ইসরাঈলকে কি জবাব দেবো?” অতঃপর আল্লাহ্ একের পর এক করে পুনর্জীবিত করেছিলেন। 


মাসআলাঃ এ ঘটনা দ্বারা নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) -এর শান প্রতিভাত হয়। হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) কে لَنۡ نُّؤۡمِنَ لَكَ  (আমরা কিছুতেই আপনার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবো না) বলার অপরাধে বানী ইসরাঈলকে ধ্বংস করা হয়। হুযূর সৈয়্যদে আ’লম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) -এর যমানার লোকদেরকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) -এর সাথে বেয়াদবী আল্লাহর গযবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তোমরা তা থেকে সাবধান থাকো! 


মাসআলাঃ এ কথাও বুঝা গেলো যে, আল্লাহ্ পাক স্বীয় দরবারের মাকবূল বান্দাদের দুআ’য় মৃতকে পুনর্জীবন দান করেন।



আয়াত নং- ৫৫

________


অনুবাদ:


৫৫ঃ এবং যখন তোমরা বলেছিলে, ‘হে মূসা! আমরা কখনো আপনার কথায় বিশ্বাস করবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আল্লাহ্কে প্রকাশ্যভাবে দেখবো না;’ তখন তোমাদেরকে বজ্রাঘাত পেয়ে বসেছিলো আর তোমরা দেখতে পাচ্ছিলে।



আয়াত নং- ৫৬

________


অনুবাদ:


৫৬ঃ অতঃপর তোমাদেরকে মৃত্যুর পর আমি পূনর্জীবিত করেছি, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার করো।



আয়াত নং- ৫৭

________


অনুবাদ:


৫৭ঃ এবং আমি তোমাদের উপর মেঘকে ছায়া দানকারী করেছি (৯২) এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্ন্’ ও ‘সালওয়া’ অবতারণ করেছি। খাও, আমার প্রদত্ত পবিত্র (হালাল) বস্তুগুলো (৯৩)। এবং তারা আমার কোন ক্ষতি করেনি;হ্যাঁ, তবে তারা নিজেদের আত্মারই ক্ষতি সাধন করছিলো।

________


টীকা-৯২ঃ যখন অবসর হয়ে হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) বনী ইসরাঈলের সেনাদলে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ শুনিয়ে দিলেন- ‘শামদেশে (সিরিয়া) হযরত ইব্রাহীম (عَلَیۡهِ السَّلَام) এবং তাঁর বংশধরদের সমাধি অবস্থিত, সেখানেই অবস্থিত বায়তুল মুক্বাদ্দাস। এ পবিত্র ভু-খন্ডকে আমালিক্বাহ গোত্রীয়দের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য (তাদের সাথে) জিহাদ করো এবং মিশর ত্যাগ করে সেখানেই আবাসভূমি করে নাও। আর মিশর ত্যাগ করাও বানী ইস্রাঈলের উপর অতি কষ্টকর ছিলো। 


তখন প্রথমে তারা এ নির্দেশ পালনে গড়িমসি করেছিলো। আর যখন বাধ্য হয়ে হযরত মূসা ও হারূন (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) -এর সৌভাগ্যময় সাহচর্যে রওয়ানা দিলো, তখন পথে যে কোন প্রকারের কষ্ট ও সমস্যার সম্মুখী হতেই হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর নিকট তারা অভিযোগ করতো। যখন তারা ঐ মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছলো, যেখানে না ছিলো গাছপালা, না ছিলো কোন ছায়া, না ছিলো কোন খাদ্য-রসদ, তখন সেখানে তারা প্রখর রোদের উত্তাপ এবং ক্ষুধার অভিযোগ করলো। আল্লাহ্ تَعَالٰی হযরত মূসা عَلَیۡهِمَا السَّلَام এর প্রার্থনাক্রমে, সাদা মেঘমালাকে তাদের ছায়াদানকারী করলেন, যা রাতদিন তাদের সাথে সাথে চলতো। রাতে তাদের জন্য আলোর থাম নেমে আসতো, যার আলোকের মধ্যে তারা কাজকর্ম সমাধা করতো। তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ অপরিষ্কার ও পুরাতন হতো না। নখ ও চুল বাড়তো না। এ সফরে তাদের যেসব সন্তান জন্মলাভ করতো তাদের পোষাকও সাথে সৃষ্টি হতো। যতটুকু তারা বড় হতো পোষাকও ততো বৃদ্ধি পেতো।


টীকা-৯৩ঃ ‘মান্ন’ তারাঞ্জবীন-এর মতো এক প্রকার মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য ছিলো, তা প্রত্যহ সোবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের অভ্যন্তরে প্রত্যেকের জন্য এক সা’ (* এক সা’ = সাড়ে চার সের বা ৪ কেজি ১০ গ্রাম প্রায়।) পরিমান আসমান থেকে নাযিল হতো। লোকেরা তা চাদর ভরে রেখে সারাদিন আহার করতো। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে এক প্রকার ছোট পাখী। বাতাস সেগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে আসতো, আর এরা সেগুলোকে শিকার করে খেতো। 


এ দু’টি বস্তু প্রতি শনিবারে মোটেই আসতো না। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে প্রত্যহ আসতো। প্রতি শ্রক্রবার অন্যান্য দিনের তুলনায় দ্বিগুণ আসতো। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিলো- ‘প্রতি শ্রক্রবার পরদিন শনিবারের জন্য প্রয়োজন মোতাবেক সঞ্চিত রাখো; কিন্তু একদিনের বেশী (খাদ্য) জমা করোনা।’ 


বানী ইসরাঈল এসব নি‘মতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। তারা অতিরিক্ত খাদ্য জমা করতে লাগলো। ফলে, তা পঁচে গেলো এবং সেগুলোর আগমন বন্ধ করে দেয়া হলো। এতে তারা নিজেদেরই ক্ষতি করলো- দুনিয়ার নি‘মাত থেকে বঞ্চিত এবং আখিরাতে কঠিন শাস্তির উপযোগী হলো।



আয়াত নং- ৫৮

________


অনুবাদ:


৫৮ঃ এবং যখন আমি বললাম, ‘এ লোকালয়ে প্রবেশ করো (৯৪)। অতঃপর তাতে যেখানে ইচ্ছা কোন প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়াই আহার করো এবং ‘দরজা’ দিয়ে সাজদারত অবস্থায় প্রবেশ করো (৯৫) আর বলো, ‘আমাদের গুনাহের ক্ষমা হোক!’ আমি (আল্লাহ্) তোমাদের অপরাধগুলো ক্ষমা করবো এবং অনতিবিলম্বে আমি নেককার লোকদের প্রতি (আমার) দান আরো বৃদ্ধি করবো (৯৬)।’

________


টীকা-৯৪ঃ এ ‘লোকালয়’ মানে ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’ কিংবা ‘আরীহা’, যা বায়তুল মুক্বাদ্দাসেরই নিকটে অবস্থিত, যেখানে ‘আমালিক্বাহ’ গোত্রের আবাস ছিলো এবং এ স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলো। এখানে খাদ্য ও ফলমূল প্রচুর ছিলো।


টীকা-৯৫ঃ এ ‘দরজা’ তাদের জন্য কা’বার বিকল্প ছিলো। সুতরাং এতে প্রবেশ করা ও এর প্রতি মুখ করে সাজদাহ করাকে তাদের গুনাহের কাফ্ফারা সাবস্থ করা হয়েছিলো।


টীকা-৯৬ঃ মাসআলাঃ এ আয়াত থেকে জানা গেলো যে, মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং শারীরিক ইবাদত (হিসেবে) সাজদা ইত্যাদি আদায় করা তাওবা বা অনুশোচনার জন্য পরিপূরক। 


মাসআলাঃ এ কথাও প্রতিভাত হয় যে, প্রসিদ্ধি প্রাপ্ত পাপের তাওবাও ঘোষণা সহকারে হওয়া অপরিহার্য।


মাসআলাঃ এ কথাও জানা গেলো যে, বরকতময় স্থানসমূহ, যেগুলো আল্লাহর রহমত বর্ষণের স্থান, সেখানে তাওবা করা এবং ইবাদত পালন করা শুভফল লাভ ও শীঘ্র কবূল হবারই উপায়। (ফতহুল আযীয্) এ জন্যই সালেহীন বান্দাদের নিয়ম চলে আসছে যে, তাঁরা নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) ও আউলিয়া কিরামের জন্মস্থান এবং মাযারসমূহে হাযির হয়ে আল্লাহর দরবারে ইস্তিগফার ও আল্লাহর ইবাদত করে থাকেন। ওরস-যিয়ারতেও এ উদ্দেশ্যেই মুখ্য থাকে।



আয়াত নং- ৫৯

________


অনুবাদ:


৫৯ঃ অতঃপর যালিমগণ অন্য বাক্য বদলে দিলো, যা তাদেরকে বলা হয়েছিলো তা ব্যতীত (৯৭); অতঃপর আমি আসমান থেকে তাদের উপর আযাব নাযিল করেছি (৯৮) প্রতিফল স্বরূপ তাদের আদেশ অমান্য করার।

________


টীকা-৯৭ঃ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে- বানী ইসরাঈলকে নির্দেশ দেয়া হলো যেন তাঁরা সাজদারত অবস্থায় ‘দরজা’য় প্রবেশ করে আর যেন মুখে حِطَّةٌ (হিত্তাতুন) ‘তাওবা এবং ক্ষমা প্রার্থনার বাক্য’ উচ্চারণ করতে থাকে; (কিন্তু) তারা উভয় হুকুমেরই বিরোধিতা করলো। তারা প্রবেশ তো করলো নিতম্বের উপর ভর করে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে আর তাওবা-বাক্যের পরিবর্তে ঠাট্টা স্বরূপ বললো حَبَّةٌ فِیۡ شَعۡرَةٍ “ (হাব্বাতুন্ ফী শা’রাতিন্)” যার অর্থ হয়- ‘চুলের মধ্যে দানা’।


টীকা-৯৮ঃ এ আযাব ছিলো মহামারী আকারে ‘প্লেগ’; যার কারণে এক মুহূর্তেই চব্বিশ হাজার লোক মৃত্যুমুখে পতিত হলো।


মাসআলাঃ সিহাহর হাদীসে বর্ণিত, “প্লেগ পূর্ববর্তী উম্মতদের আযাবেরই অবশিষ্ট। যখন তোমাদের শহরে দেখা দেয় তখন সেখান থেকে (অন্যত্র) পলায়োন করোনা, অন্য শহরে হলেও সেখানে যেওনা।”


মাসআলাঃ বিশুদ্ধ হাদীস শরীফে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি মহামারী দুর্গত এলাকায় আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর ধৈর্যশীল থাকে, যদি সে মহামারী থেকে বেঁচে যায় তবুও শাহাদাতের সাওয়াব পাবে। 



আয়াত নং- ৬০

________


অনুবাদ:


৬০ঃ এবং মূসা যখন নিজ সম্প্রদায়ের জন্য পানি প্রার্থনা করলো তখন আমি বললাম, ‘এ পাথরের উপর তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত করো।’ তৎক্ষণাৎ এর ভিতর থেকে বারটি প্রস্রবণ প্রবাহিত হলো (৯৯)। প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ ঘাট (পান-স্থান) চিনে নিলো। (তোমরা) খাও এবং পান করো খোদা প্রদত্ত রিয্ক্ব (১০০) এবং পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না (১০১)।

________


টীকা-৯৯ঃ যখন বানী ইসরাঈল সফরে পানি পায়নি, অসহনীয় পিপাসায় কাতর হয়ে অভিযোগ করলো, তখন হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর প্রতি নির্দেশ এলো- ‘আপন লাঠি দ্বারা পাথরের উপর আঘাত করো।’ তাঁর (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর নিকট চতুষ্কোন বিশিষ্ট পাথর ছিলো। যখন পানির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতো তখনই তিনি এর উপর লাঠির আঘাত করতেন। (ফলে,) তা থেকে বারটি প্রস্রবণ প্রবাহিত হতো। আর সবাই তৃষ্ণা মিটাতো। এটা হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) -এর একটা বড় মু’জিযা ছিলো; কিন্তু নাবীকুল সরদার হুযূর কারীম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর হাতের আঙ্গুল মুবারক থেকে পানির প্রস্রবণ প্রবাহিত করে সাহাবা কিরামের বিরাট জামা‘আতের পানির চাহিদা মিটানো ততোধিক মহান ও উন্নততর মু’জিযা। কেননা, মানাবীয় দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ থেকে প্রস্রবণ জারী হওয়া পাথরের তুলনায় অধিক আশ্চর্যের বিষয়। (খাযিন ও মাদারিক) 


টীকা-১০০ঃ অর্থাৎ আসমানী খাদ্য- ‘মান্ন’ ও ‘সালওয়া’ খাও এবং এ পাথরের প্রস্রবণ থেকে প্রবাহিত পানি পান করো, যা আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে, বিনা পরিশ্রমে তোমাদের অর্জিত। 


টীকা-১০১ঃ নি‘মাতসমূহের কথা উল্লেখ করার পর ইস্রাঈল সম্প্রদায়ের অযোগ্যতা, অসাহসিকতা এবং অবাধ্যতার কতিপয় ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে-



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ