তাফসীরে কুরআন ৮

 

তাফসীরে কুরআন ৮  সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৭১-৮০  (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

 সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৭১-৮০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

আয়াত নং- ৭১

________


অনুবাদ:


৭১ঃ (হযরত মূসা) বললেন, ‘তিনি (আল্লাহ্) ইরশাদ করেছেন, তা এমন একটা গাভী, যা দ্বারা কোন খিদমত লওয়া হয় না, না জমি কর্ষণে ব্যবহৃত হয়, না ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়, নিখুঁত- যাতে কোন প্রকার দাগ নেই।’(তারা) বললো, ‘এখনই আপনি সঠিক বর্ণনা এনেছেন (১২০)। অতঃপর তারা তা যবেহ করেছিলো এবং তারা যে যবেহ করবে তা বুঝা যাচ্ছিলোনা (১২১)

________


টীকা-১২০ঃ অর্থাৎ মনে এখনই শান্তনা এসেছে এবং পূর্ণাঙ্গরূপে গাভীর অবস্থা ও বৈশিষ্টাবলী জানা গেছে। অতঃপর তারা গাভীর তালাশ আরম্ভ করলো। সে এলাকাব্যাপী এ ধরণের একটি মাত্র গাভী ছিলো। সেটার অবস্থা এই-বানী ইসরাঈলে একজন নেককার ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর এক অল্প বয়স্ক সন্তান ছিলো। তাঁর নিকট একটা গরুর বাছুর ব্যতীত অন্য কিছুই ছিলো না। তিনি বাছুরটার ঘাড়ে একটা মোহর ছেপে দিয়ে সেটা আল্লাহর নামে ছেড়ে দিলেন। আর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমি এ বাছুরটা আমার এ সন্তানের জন্য আপনারই তত্ত্বাবধানে জমা রাখছি, যাতে এ সন্তান বড় হলে এটা তার কাজে আসে।” এদিকে তার ইনতিকালতো হয়ে গেলো। 


ওদিকে বাছুরটা আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণে জঙ্গলের মধ্যে লালিত পালিত হচ্ছিলো। ছেলেটা বয়োপ্রাপ্ত হলো এবং আল্লাহর অনুগ্রহে সৎ ও পরহেযগার হলো এবং মায়ের অনুগত ছিলো। একদিন তার মা বললেন, “হে আমার চোখের আলো! তোমার পিতা তোমার জন্য আল্লাহর নামে অমুক জঙ্গলে একটা গরু বাছুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেটা বড় হয়েছে। জঙ্গলে গিয়ে সেটা নিয়ে এসো। আর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করো যেন সেটা তোমাকে প্রদান করেন।” ছেলেটা জঙ্গলে গাভীটা দেখতে পেলো এবং তার মায়ের বর্ণিত সব বৈশিষ্ট্যও গাভীতে পেয়েছিলো। আর আল্লাহরশপথ উচ্চারণ করে (সেটাকে) আহ্বান করলে সেটা হাযির হলো। যুবক সেটা মায়ের খিদমতে হাযির করলো। মা তাকে বাজারে নিয়ে সেটা তিন দিনার মূল্যে বিক্রি করার নির্দেশ দিলেন, আর এ শর্তারোপ করলেন যেন উক্ত মূল্যে বিক্রি হলে পুনরায় তাঁর (মা) অনুমতি নেয়া হয়। তদানিন্তন যুগে এ ধরণের গরুর মূল্য সে এলাকায় তিন দিনারই ছিলো। 


যুবক যখন গাভীটা নিয়ে বাজারে এলো, তখন একজন ফিরিশতা খরিদ্দারের বেশে আসলেন এবং ঐ গাভীর মূল্য ছয় দিনার দেয়ার প্রস্তাব করলেন, কিন্তু শর্তারোপ করলেন যে, যুবক তার মায়ের অনুমতি নিতে পারবে না। যুবক এতে রাজি হলো না। অতঃপর যুবক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো। মা ছয় দিনার মূল্যে গরুটা বিক্রি করতে সম্মতি দিলেন; কিন্তু পূর্বের ন্যায় তাঁর ইচ্ছা যাচাই করার শর্তখানা আরোপ করলেন। যুবক অতঃপর বাজারে এলো। এবার ফিরিশতা গরুর দাম বার দিনারে উন্নীত করলেন। আর বললেন, “এটা মায়ের পুনঃঅনুমতির উপর মাওকূফ রেখোনা।” কিন্তু যুবক মানলোনা। অতঃপর সে মাকে তা অবগত করলো। সেই দূরদর্শীনী মা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন- ইনি কোন খরিদ্দার নন, কোন ফিরিশতা হবেন, যিনি পরীক্ষা করার জন্য আসেন । মা পুত্রকে বললেন, “এবার তুমি সে খরিদ্দারকে এ কথা জিজ্ঞেস করবে- “আপনি আমাদেরকে এ গাভীটা বিক্রি করার নির্দেশ দিচ্ছেন কিনা?’ যুবক তাই করলো। ফিরিশতা বলে দিলেন, “এখন এটা রেখে দাও। যখন বানী ইস্রাঈলের লোকেরা (গরুটা) খরিদ করতে আসবে তখন এ দাম নির্ধারণ করবে যে, সেটার চামড়া ভর্তি স্বর্ণ দিতে হবে।” 


যুবক গাভীটা ঘরে নিয়ে এলো। আর যখন বানী ইসরাঈল তালাশ করতে তার বাড়ীতে এসে পৌঁছলো, তখন উক্ত দামই সাব্যস্ত করলো এবং হযরত মূসা عَلَیۡهِ السَّلَام) এর যামিনে গাভীটা বানী ইস্রাঈলের নিকট সোপর্দ করা হলো। 


কতিপয় মাসআলাঃ এ ঘটনা থেকে কয়েকটা ঘটনা প্রতিভাত হয়ঃ (১) যে ব্যক্তি স্বীয় পরিবার-পরিজনকে আল্লাহর হিফাযতে সোপর্দ করে, আল্লাহ্ তাদেরকে এমনিভাবে উৎকৃষ্ট ধরণের লালন-পালন করেন। (২) যে ব্যক্তি আপন মাল-দৌলত আল্লাহর উপর ভরসা করে তাঁরই আমানতে রাখে, আল্লাহ্ পাক তাতে বরকত দান করেন। (৩) মাতা-পিতার আনুগত্য আল্লাহ্ নিকট পছন্দনীয়। (৪) ‘গায়বী ফয়য’ আল্লাহর রাহে ক্বুরবানী ও দান সাদাক্বাহ করার মাধ্যমে অর্জিত হয় (৫) আল্লাহর রাহে উৎকৃষ্ট মাল দান করা উচিত। (৬) গাভী ক্বুরবানী করাই উত্তম। 


টীকা-১২১ঃ বানী ইস্রাঈল কর্তৃক পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নাবলী,নিজেদের অবমাননার আশঙ্কা এবং গাভীর অগ্নিমূল্য থেকে এটাই প্রকাশ পাচ্ছিলো যে, তারা যবেহ করার ইচ্ছা রাখতো না; কিন্তু যখনই তাদের সব প্রশ্নের যথার্থ জবাব দেয়া হলো, তখন তারা গাভী যবেহ করতে বাধ্য হলো।



আয়াত নং- ৭২

________


অনুবাদ:


৭২ঃ এবং যখন তোমরা একটা খুন সংঘটিত করেছিলে, তখন একে অন্যের প্রতি এর অপবাদ চাপিয়ে দিচ্ছিলে এবং আল্লাহর প্রকাশ করে দেয়ার ছিলো যা তোমরা গোপন করছিলে।



আয়াত নং- ৭৩

________


অনুবাদ:


৭৩ঃ অতঃপর আমি বললাম, ‘এ নিহত ব্যক্তির গায়ে সে গাভীর একটা টুকরো নিক্ষেপ করো (১২২)।’ আল্লাহ্ এভাবেই মৃতকে জীবিত করবেন এবং তোমাদেরকে আপন (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দেখাচ্ছেন, যাতে তোমরা উপলব্ধি করতে পারো (১২৩)।

________


টীকা-১২২ঃ বানী ইস্রাঈল গাভীটা যবেহ করে এর একটা অংশ দ্বারা নিহত ব্যক্তিকে আঘাত করলো। লোকটা আল্লাহর নির্দেশক্রমে জীবিত হলো। তার গলার ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোয়ারা প্রবাহিত হচ্ছিলো। সে স্বীয় চাচাতো ভাইয়ের নাম উল্লেখ করে বললো, “সেই আমাকে হত্যা করেছে।” তখন তাকেও স্বীকার করতে হলো। আর হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) তার উপর ‘ক্বিসাস’ (খুনের বদলে খুন) -এর নির্দেশ দিলেন। অতঃপর শরীয়তের নির্দেশ হলো। (আয়াত দেখুন)। 


মাসআলাঃ হত্যাকারী হত্যাকৃতের ‘মীরাস’ (উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে।(* যদি সে ওয়ারিশ হয়।)


মাসআলাঃ অবশ্য যদি বিচারক বিদ্রোহীকে হত্যা করেন কিংবা কেউ আত্মরক্ষার জন্য কোন আক্রমনকারীর আক্রমনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে আর এতে সেই আক্রমনকারী নিহত হয়, তবে নিহত ব্যক্তির ‘মীরাস’(উত্তরাধিককার) থেকে বঞ্চিত হবে না। 


টীকা-১২৩ঃ এবং তোমরা অনুধাবন করো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ تَعَالٰی  মৃতকে জীবন দানে সক্ষম এবং শেষ বিচারের দিন মৃতদেরকে জীবিত করা এবং তার কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ নেয়া সত্য।



আয়াত নং- ৭৪

________


অনুবাদ:


৭৪ঃ অতঃপর এরপর তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেলো (১২৪)। তখন তা পাথরসমূহের ন্যায় হয়; বরং তদপেক্ষাও কঠিনতর এবং পাথরগুলোর মধ্যে তো কিছু এমনও আছে, যেগুলো থেকে নদীসমূহ প্রবাহিত হয় এবং কতেক এমনও রয়েছে, যেগুলো ফেটে যায়-তখন সেগুলো থেকে পানি নির্গত হয়; এবং কতেক এমনও আছে, যেগুলো আল্লাহর ভয়ে গড়িয়ে পড়ে (১২৫)। এবং আল্লাহ্ তোমাদের কৃতকর্মগুলো সম্পর্কে অনবহিত নন।

________


টীকা-১২৪ঃ কুদরতের এমন মহান নিদর্শনসমূহ থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করোনি। 


টীকা-১২৫ঃ এতদসত্ত্বেও তোমাদের অন্তর প্রভাবিত হবার নয়। পাথরসমূহকেও আল্লাহ্ تَعَالٰی বুঝশক্তি দান করেছেন। এদের মধ্যে আল্লাহর ভয় থাকে, এরাও আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে। আল্লাহ্ تَعَالٰی ইরশাদ করেন - وَاِنۡ مِّنۡ شَیۡءٍ اِلَّا یُسَبِّحُ بِحَمۡدِهٖ  অর্থাৎ নিশ্চয়ই সবকিছু আল্লাহর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে।” মুসলিম শরীফে হযরত জাবির (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) থেকে বর্ণিত, বিশ্বকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ইরশাদ করেছেন, “আমি সেই পাথরকে চিনি, যা আমাকে নাবূয়্যাত প্রকাশের পূর্বে সালাম করতো।” তিরমিযী শরীফে হযরত আলী (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) থেকে বর্ণিত, “আমি বিশ্বকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর সাথে মক্কার বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমন করেছি। (দেখেছি) যে কোন গাছপালা কিংবা পাহাড় হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর সামনে পড়তো প্রত্যেকটি তাঁকে اَلسَّلَامُ عَلَیۡكَ یَا رَسُوۡلَ اللّٰه  আরয করতো।”



আয়াত নং- ৭৫

________


অনুবাদ:


৭৫ঃ অতঃপর, হে মুসলমানগণ! তোমরা কি এ আশা পোষণ করো যে, এরা (ইহুদীগণ) তোমাদেরকে বিশ্বাস করবে? আর তাদের মধ্যকার একদল তো এমনই ছিলো যে, তারা আল্লাহর কালাম (বাণী) শ্রবণ করতো অতঃপর বুঝার পর সেটাকে জেনে বুঝে বিকৃত করতো (১২৬)।

________


টীকা-১২৬ঃ যেমন তারা তাওরীতে বিকৃতি সাধন করেছিলো বিশ্বকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর না’ত (প্রশংসা) বদলে ফেলেছিলো।



আয়াত নং- ৭৬

________


অনুবাদ:


৭৬ঃ এবং যখন মুসলমানদের সাথে মিলতো, তখন বলতো, ‘আমরা ঈমান এনেছি (১২৭)।’ আর যখন পরস্পর আলাদাভাবে মিলিত হয় তখন বলে, ‘সেই জ্ঞান, যা আল্লাহ্ পাক তোমাদের উপর খুলে দিয়েছেন তা কি মুসলমানদেরকে বলে দিচ্ছো? এতে করে (তারা) তোমাদের প্রতিপালকের দরবারে তোমাদের বিরুদ্ধে দলিল পেশ করবে। তোমাদের কি বুঝ-শক্তি নেই?’

________


টীকা-১২৭ঃ শানে নুযূলঃ এ আয়াত সেই ইহুদীদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে, যারা বিশ্বকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর সময়ে ছিলো। হযরত ইবনে আব্বাস (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا) ফরমাইয়াছেন, ইহুদী মুনাফিক্বগণ যখন সাহাবায়ে কিরামের সাথে সাক্ষাত করতো তখন বলতো, “তোমরা যাঁর উপর ঈমান এনেছো আমরাও তাঁর উপর ঈমান এনেছি। তোমরা সত্যের উপর আছো এবং তোমাদের আঁক্বা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) ও সত্য। আমরা তাঁর প্রশংসা ও গুণাবলীর বর্ণনা আমাদের কিতাব তাওরীতে পেয়ে থাকি।” এদেরকে ইহুদী নেতৃবর্গ তিরস্কার করতো। এর বর্ণনা আয়াতাংশ وَ اِذَا خَلَا بَعۡضُہُمۡ (এবং যখন তারা আলাদা হতো) এ রয়েছে। (খাযিন) 


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এ থেকে জানা গেলো যে, সত্য গোপন করা, সৈয়্যদে আলম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর গুণাবলী গোপন করা এবং তাঁর ‘কামালাত’ (পূর্ণতাসমূহ) অস্বীকার করা ইহুদীদের স্বভাব। আজকালকার অনেক পথভ্রষ্টের মধ্যেও এ স্বভাব পরিলক্ষিত হয়।



আয়াত নং- ৭৭

________


অনুবাদ:


৭৭ঃ তারা কি জানেনা যে, আল্লাহ্ জানেন যা কিছু তারা গোপন করে এবং যা কিছু তারা প্রকাশ (ঘোষণা) করে?



আয়াত নং- ৭৮

________


অনুবাদ:


৭৮ঃ এবং তাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর লোক রয়েছে, যারা কিতাব (১২৮) সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না, কিন্তু মৌখিকভাবে পড়তে জানে মাত্র (১২৯) কিংবা নিজেদের কিছু মনগড়া কথাবার্তা; তারা নিরেট কল্পনার মধ্যে রয়েছে।

________


টীকা-১২৮ঃ ‘কিতাব’ মানে তাওরীত। 


টীকা-১২৯ঃ اَمَانِیۡ। اُمۡنِیَّةٌ এর বহুবচন। এর অর্থ ‘মৌখিকভাবে পাঠ করা’। হযরত ইবনে আব্বাস (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا) থেকে বর্ণিত, এ আয়াত শরীফের অর্থ হলো- মূলতঃ তারা কিতাব জানতো না; কিন্তু মৌখিকভাবে পড়তে পারতো, অর্থ ও মাহাত্ম বুঝা ব্যতীত। (খাযিন) 


কোন কোন তাফসীরকার আয়াতের এ অর্থও বর্ণনা করেছেন- اَمَانِیۡ (আমানী) অর্থ ‘সেসব মিথ্যা ও মনগড়া কথাবার্তা, যেগুলো ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের আলিমদের মুখে শুনে যাচাই ব্যতীরেকে মেনে নিয়েছিলো।’



আয়াত নং- ৭৯

________


অনুবাদ:


৭৯ঃ সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্যই যারা কিতাব নিজেদের হাতে রচনা করে, অতঃপর বলে বেড়ায়, ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকেই;’ এ উদ্দেশ্যেই যে এর পরিবর্তে তারা স্বল্প মূল্যই অর্জন করবে (১৩০) সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্যই, তাদের আপন হাতে কিতাব রচনার কারণে। আর দুর্ভোগ তাদের জন্যই, তাদের এ (অন্যায়) উপার্জনের দরুন।

________


টীকা-১৩০ঃ শানে নুযূলঃ যখন নাবীকুল সরদার (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) মাদীনা তৈয়্যবাহ্য় তাশরীফ এনেছিলেন তখন তাওরীতের আলিম সম্প্রদায় এবং ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ এ আশংকা বোধ করেছিলো যে, তাদের আয় বন্ধ হয়ে যাবে এবং নেতৃত্বও চলে যাবে। কারণ, তাওরীতে হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর গড়নগত বৈশিষ্টাবলী এবং চরিত্রের গুণাবলী উল্লেখিত হয়েছে।


লোকেরা যখন হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) কে এর অনুরূপ পাবে তৎক্ষণাৎ তাঁর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) উপর ঈমান নিয়ে আসবে আর তাদের ওলামা সম্প্রদায় এবং নেতৃবর্গকে পরিত্যাগ করবে। এ আশংকার কারণে তারা তাওরীতে পরিবর্তন বা বিকৃতি সাধন করেছিলো এবং হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর পবিত্র দেহ আকৃতির বর্ণনা বিকৃত করেছিলো। 


উদাহরণস্বরূপ, তাওরীতে তাঁর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) গুণাবলীর উল্লেখ এরূপ ছিলো, “তাঁর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) চেহারা মুবারক আকর্ষণীয়, চুল মুবারক সুন্দর, মুবারক চক্ষুদ্বয় সুরমাময় আর তাঁর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) গড়ন হবে মাঝারি।” এসব মিটিয়ে দিয়ে তারা রচনা করলো- “তিনি (হুযূর) হবেন খুব লম্বা গড়নের, চক্ষুর মণিদ্বয় নীলাভ, চুল কোঁকড়ানো।’ এটাই জনসাধারণের মাঝে প্রচার করতো। আর বলতো, “এটাই হলো আল্লাহর কিতাবের সারকথা।” তাদের ধারণা ছিলো-লোকেরা যখন হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) কে এর বিপরীত পাবে তখন তারা তাঁর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) উপর ঈমান আনবে না; বরং তাদেরই প্রতি আসক্ত থেকে যাবে। আর তাদের আয়-আমদানী কিঞ্চিত পরিমাণও হ্রাস পাবে না।



আয়াত নং- ৮০

________


অনুবাদ:


৮০ঃ এবং তারা (ইহুদীগণ) বললো, ‘আমাদেরকে তো আগুন স্পর্শ করবে না, কিন্তু মাত্র দিন কতেক (১৩১)।’ (হে হাবীব!) আপনি বলে দিন, ‘তোমরা কি খোদার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছো? তবে তো আল্লাহ্ তা‘আলা সে অঙ্গীকার কখনো ভঙ্গ করবেন না (১৩২), কিংবা আল্লাহ্ সম্পর্কে এমন কিছু উক্তি করে থাকো যা সম্পর্কে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই!’

________


টীকা-১৩১ঃ শানে নুযূলঃ হযরতে ইবনে আব্বাস (رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا) থেকে বর্ণিত, ইহুদী সম্প্রদায় বলতো যে, তারা কখনো দোযখে প্রবেশ করবে না, কিন্তু কিছু সময়ের জন্য, যতদিন তাদের পূর্বপুরুষগণ ‘গরু বাছুর’ এর পূজা করেছিলো। আর তা চল্লিশ দিন মাত্র। অতঃপর তারা শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। এর খন্ডনে এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে। 


টীকা-১৩২ঃ কেননা, মিথ্যা অতীব নিন্দনীয় দোষ। দোষত্রুটি আল্লাহ্ পাকের শানে সম্পূর্ণ অসম্ভব। কাজেই তাঁর পক্ষে মিথ্যা বলাতো সম্ভবই নয়। কিন্তু যখন আল্লাহ্ تَعَالٰی তোমাদের সাথে মাত্র চল্লিশ দিন শাস্তি দেওয়ার পর তোমাদেরকে মুক্তি দেওয়ার কোন ওয়াদাই করেননি, তখন তোমাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ