তাফসীরে কুরআন ৯

  

তাফসীরে কুরআন ৯  সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৮১-৯০  (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

সূরা বাক্বারা : আয়াত নং- ৮১-৯০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

আয়াত নং- ৮১

________


অনুবাদ:


৮১ঃ হ্যাঁ,কেন এমন হবেনা? যারা পাপার্জন করেছে এবং তাদের পাপরাশি তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে (১৩৩)- তারা দোযখবাসীদেরই অন্তর্ভুক্ত; স্থায়ীভাবে তাতেই থাকতে হবে।

________


টীকা-১৩৩ঃ এ আয়াতে ‘গুনাহ’ অর্থ ‘শির্ক ও কুফর’ এবং ‘পাপরাশি পরিবেষ্টন করেছে’ মানে ‘মুক্তির সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে’ আর এ শির্ক ও কুফরের অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। কারণ, মু’মিন যতই মহাপাপী হোক না কেন, পাপরাশিতে পরিবেষ্টিত হয় না। কারণ, ঈমান, যা হচ্ছে-সর্ববৃহৎ ইবাদত, তা তার সাথেই রয়েছে।



আয়াত নং- ৮২

________


অনুবাদ:


৮২ঃ যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তারা জান্নাতবাসী। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকবে।

________


টীকা-১৩৩ঃ এ আয়াতে ‘গুনাহ’ অর্থ ‘শির্ক ও কুফর’ এবং ‘পাপরাশি পরিবেষ্টন করেছে’ মানে ‘মুক্তির সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে’ আর এ শির্ক ও কুফরের অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। কারণ, মু’মিন যতই মহাপাপী হোক না কেন, পাপরাশিতে পরিবেষ্টিত হয় না। কারণ, ঈমান, যা হচ্ছে-সর্ববৃহৎ ইবাদত, তা তার সাথেই রয়েছে।



আয়াত নং- ৮৩

________


অনুবাদ:


৮৩ঃ এবং যখন আমি বনী ইস্রাঈল থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম, ‘(তোমরা) আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকারো ইবাদত করবে না এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো (১৩৪)।আর আত্মীয়-স্বজনদের সাথে, এতিম ও মিসকীনদের সাথে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করো (১৩৫), নামায কায়েম রাখো ও যাকাত প্রদান করো।’ অতঃপর তোমরা ফিরে গিয়েছিলে (১৩৬), কিন্তু তোমাদের মধ্য থেকে অল্প সংখ্যক লোক (১৩৭); এবং তোমরা বিমুখ (১৩৮)।

________


টীকা-১৩৪ঃ আল্লাহ্ تَعَالٰی তাঁরই ইবাদত করার নির্দেশ প্রদানের পর মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে জানা গেলো যে, মাতা-পিতার সেবা-যত্ন করা অতীব জরুরী। মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করার অর্থ হচ্ছে ‘এমন কোন কথা না বলা কিংবা এমন কোন কাজ না করা, যাতে তাঁদের মনে আঘাত লাগে। আর শারীরিক ও আর্থিকভাবে তাঁদের সেবা-যত্ন করায় কোন প্রকার ত্রুটি না করা। যখন তাঁদের প্রয়োজন হয় তখনই তাঁদের খিদমতে হাযির হওয়া।’ 


মাসআলাঃ যদি মাতা-পিতা তাঁদের খেদমতের নিমিত্ত কোন নফল ইবাদত ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন তবে তা ছেড়ে দেবে। তাঁদের খিদমত নফল ইবাদত অপেক্ষা অগ্রগণ্য। 


মাসআলাঃ কোন ওয়াজিব ইবাদত মাতাপিতার নির্দেশে ত্যাগ করা যাবে না। মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নিয়মাবলী, যেগুলো বহুসংখ্যক হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত, তা হচ্ছে- অকপট চিত্তে তাঁদের সাথে ভালবাসা রাখা, চাল-চলন, কথাবার্তা ও উঠাবসায় আদব বজায় রাখাকে অত্যাবশ্যকীয় জানা,তাঁদের শানে সম্মান সূচক শব্দ ব্যবহার করা, তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকা, স্বীয় উৎকৃষ্ট মাল-দৌলত তাঁদের থেকে না বাঁচানো, তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের ওসীয়ত পূর্ণ করা, তাঁদের জন্য ফাতেহাখানি, দান-খয়রাত এবং ক্বুরআন মাজীদ তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের রূহে ঈসালে সাওয়াব করা, আল্লাহ্ تَعَالٰی এর দরবারে তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা এবং প্রতি সপ্তাহে তাঁদের কবর যিয়ারত করা। (ফতহুল আযীয) 


মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করার মধ্যে এ কথাও অন্তর্ভুক্ত যে, যদি তাঁরা কোন গুনাহে অভ্যস্থ হন কিংবা কোন বদ-মাযহাব (ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী)- এর শিকার হয়ে পড়েন তবে তাঁদেরকে অতীব নম্রতা ও বিনয় সহকারে সংশোধন, খোদাভীতি এবং সঠিক আক্বীদা (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা) এর দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকা। (খাযিন) 


টীকা-১৩৫ঃ ‘সদালাপ’- অর্থ সৎ কার্যাবলীর দিকে উৎসাহ প্রদান এবং অসৎ কার্যাদি থেকে বাধা দেয়া। হযরত ইবনে আব্বাস ( رَضِيَ اللّٰهُ تَعَالٰی عَنۡهُمَا ) বর্ণনা করেন, এর অর্থ হচ্ছে- বিশ্বকুল সরদার হুযূর কারীম صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর শানে সঠিক ও সত্য কথা বলা। যদি কেউ জিজ্ঞেসা করে, তবে তার জবাবে হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর পূর্ণতাসমূহ ও তাঁর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর গুনাবলী সঠিকভাবে বর্ণনা করা; তাঁর গুণাবলী গোপন না করা। 


টীকা-১৩৬ঃ অঙ্গীকারের পর, 


টীকা-১৩৭ঃ যাঁরা ঈমান এনেছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও তাঁর সঙ্গীদের মতো, তাঁরা তো অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন। 


টীকা-১৩৮ঃ তোমাদের সম্প্রদায়ের লোকদের অভ্যাসই হলো মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং ওয়াদা থেকে ফিরে যাওয়া।



আয়াত নং- ৮৪

________


অনুবাদ:


৮৪ঃ এবং যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম (এ মর্মে যে, আপন লোকদেরকে খুন করবেনা এবং আপন লোকদের তাদের বস্তি গুলো থেকে তাড়িয়ে দিবেনা। অতঃপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা হলে সাক্ষী।



আয়াত নং- ৮৫

________


অনুবাদ:


৮৫ঃ অতঃপর এই যে, তোমরা! আপন লোকদেরকে হত্যা করতে আরম্ভ করেছো এবং আপন লোকদের মধ্য থেকে একটা দলকে তাদের মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছো, তাদের বিরুদ্ধে (তাদেরই বিরুদ্ধপক্ষীয়দেরকে) সাহায্য করছো গুনাহ্ ও সীমালংঘনে। আর যদি তারা বন্দী হয়ে তোমাদের নিকট আসে, তবে তোমরা বিনিময় (মুক্তিপন) দিয়ে (তাদেরকে) মুক্ত করে নিয়ে থাকো এবং তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া তোমাদের উপর হারাম (১৩৯)। তবে কি খোদার কিছু সংখ্যক নির্দেশের উপর ঈমান আনছো এবং কিছু সংখ্যক নির্দেশকে অস্বীকার করছো? সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে এরূপ করে তার প্রতিফল কি? কিন্তু দুনিয়াতে অপমানিত হওয়াই (১৪০) এবং ক্বিয়ামতে কঠিনতম শাস্তির দিকে ধাবিত করা হবে;এবং আল্লাহ্ তোমাদের কার্যাদি সম্পর্কে অনবহিত নন (১৪১)

________


টীকা-১৩৯ঃ শানে নুযূলঃ তাওরীতে ইস্রাঈল সম্প্রদায় থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিলো যেন তারা পরস্পরের মধ্যে একে অপরকে হত্যা না করে, মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত না করে এবং বানী ইস্রাঈলের কেউ কারো নিকট বন্দী থাকলে তাকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে নেয়। এ অঙ্গীকার পূরণের জন্য তারা স্বীকাররোক্তি দিয়েছিলো, নিজেদের উপর সাক্ষীও হয়েছিলো; কিন্তু এর উপর স্থির রইলো না এবং তা থেকে ফিরে গিয়েছিলো। 


ঘটনার প্রকৃতি নিম্নরূপঃ মদীনা শরীফের পাশ্ববর্তী এলাকায় ইহুদীদের দু’গোত্র- বনূ ক্বোরায়যা ও বনূ নাযীর বসবাস করতো। মদীনা শরীফে আরো দু’টি গোত্র- আউস এবং খাযরাযও বসবাস করতো। বনূ ক্বোরায়যা ছিলো আউস এর মিত্র আর বনূ নযীর ছিলো খাযরাজের মিত্র। অর্থাৎ প্রত্যেক গোত্র স্বীয় বন্ধু গোত্রের সাথে এ শপথ সূত্রেই আবদ্ধ ছিলো যে, ‘যদি আমাদের মধ্য থেকে কারো উপর কেউ হামলা করে বসে, তবে অপর মিত্রগোত্র তাকে সাহায্য করবে।’ 


আউস এবং খাযরাজ পরস্পর যুদ্ধ করতো। বনূ ক্বুরায়যা আউস গোত্রের এবং বনূ নযীর খাযরাজের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতো এবং মিত্রগোত্রের সাথে মিলিত হয়ে একে অন্যের উপর তরবারি চালাতো। বনূ ক্বোরায়যা বনূ নযীরকে এবং বনূ নযীর বনূ ক্বোরায়যাকে হত্যা করতো, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিতো এবং তাদেরকে তাদের বাসস্থান থেকে তাড়িয়ে দিতো। 


কিন্তু যখন তাদের আপন গোত্রের লোককে তাদের বন্ধু-গোত্রের কেউ বন্ধী করতো, তখন তারা তাদেরকে মুক্তিপন দিয়ে মুক্ত করে নিতো। যেমন- বনূ নাযীরের কোন ব্যক্তি যদি আউস গোত্রের হাতে বন্দী হতো তবে বনূ ক্বুরায়যা আউস গোত্রকে (আর্থিক) মুক্তিপন দিয়ে মুক্ত করে নিতো। এতদ্বসত্ত্বেও যদি সেই ব্যক্তি যুদ্ধের সময় তাদের নাগালে এসে যেতো তবে তাকে হত্যার বেলায় কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করতো না। তাদের ঐ অপকর্মের জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে যে, ‘যখন তোমরা আপন লোকদেরকে হত্যা না করার, তাদেরকে বস্তিগুলো থেকে তাড়িয়ে না দেয়ার এবং তাদের বন্দীদেরকে মুক্ত করে নেয়ার অঙ্গীকার করেছিলে, তখন এ অর্থ কি এ যে, হত্যাও তাড়ানোর বেলায় ক্ষমা করবে না, কিন্তু কেউ বন্দী হলে তাকে মুক্ত করে নিবে? অঙ্গীকারের কিছু মেনে নেয়া এবং কিছু অমান্য করার কি অর্থ হতে পারে? যখন তোমরা হত্যা ও বিতাড়িত করা থেকে বিরত হওনি তখন তোমরা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছো এবং হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছো। আর এ ধরণের হারাম কাজকে হালাল জ্ঞান করে কাফিরে পরিণত হয়েছো। 


মাসআলাঃ এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো যে, যুলুম ও হারামে সাহায্য করাও হারাম। 


মাসআলাঃ এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো যে, অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত হারামকে হালাল জানা কুফর। 


মাসআলাঃ এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর কিতাবের একটা হুকুম অমান্য করাও গোটা কিতাবকে অমান্য করারই শামিল এবং কুফর। 


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এ আয়াতে এ হুশিয়ারী রয়েছে যে, যখন আল্লাহর বিধানগুলো থেকে কিছু মান্য করা এবং কিছু অমান্য করা কুফর, তখন ইহুদী সম্প্রদায় কর্তৃক হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم কে অমান্য করার সাথে হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর নাবূয়্যাতকে মান্য করা কুফর থেকে রক্ষা করতে পারে না। 


টীকা-১৪০ঃ পৃথিবীতে তো এ অবমাননা হলো যে, বনূ ক্বুরায়যা তৃতীয় হিজরী সনে নিহত হয়- একদিনে তাদের সাতশ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছিলো এবং বনূ নযীরের লোকদেরকে এর পূর্বেই বহিষ্কার করা হয়েছে। মিত্রদের খাতিরে আল্লাহর অঙ্গীকারের বিরোধীতাই এটা পরিণাম-ফল ছিলো।


মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা গেলো যে, কারো পক্ষপাতিত্বের খাতিরে ধর্মের বিরোধিতা করা পরকালীন শাস্তি ছাড়াও পার্থিব জীবনে অবমাননা এবং লাঞ্ছনারই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 


টীকা-১৪১ঃ এতে যেমন অবাধ্যদের জন্য কঠিন শাস্তির এ হুমকি রয়েছে যে, আল্লাহ্ তোমাদের কার্যাবলি সম্পর্কে অনবহিত নন, তোমাদের অবাধ্যতার উপর তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন; তেমনি মু’মিনগণ এবং সালেহীন বান্দাদের জন্য এ খোশখবরও রয়েছে যে, তাঁদের সৎকার্যাদির জন্য তাঁরা উৎকৃষ্টতম প্রতিদান লাভ করবেন। (তাফসীর-ই-কবির)



আয়াত নং- ৮৬

________


অনুবাদ:


৮৬ঃ এরাই হচ্ছে ঐ সব লোক, যারা পরকালের পরিবর্তে পার্থিব জীবনকে খরিদ করেছে। সুতরাং তাদের উপর থেকে না শাস্তি হ্রাস করা হবে এবং না তাদের সাহায্য করা হবে।



আয়াত নং- ৮৭

________


অনুবাদ:


৮৭ঃ এবং নিশ্চয়ই আমি মূসাকে কিতাব দান করেছি (১৪২) এবং তারপর একের পর এক রসূল প্রেরণ করেছি (১৪৩) এবং আমি (হযরত) মারইয়ামের পুত্র (হযরত) ঈসাকে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ দান করেছি (১৪৪) এবং ‘পবিত্র রূহ’ দ্বারা (১৪৫) তাকে সাহায্য করেছি (১৪৬)। তবে কি যখন কোন রসূল তোমাদের নিকট এমন কিছু নিয়ে আসেন, যা তোমাদের মন চায়না (মনঃপূত হয়না), (তখনই তোমরা) অহংকার করো? অতঃপর সেসব (নাবীগণ) এর মধ্য থেকে একদলকে তোমরা অস্বীকার করছো এবং একদলকে শহীদ করছো (১৪৭)?

________


টীকা-১৪২ঃ এ ‘কিতাব’ মানে তাওরীত, যা’তে আল্লাহ্ تَعَالٰی এর সমস্ত অঙ্গীকার উল্লেখিত ছিলো। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ছিলো- প্রতিটি যুগের পয়গাম্বারগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) এর আনুগত্য করা, তাঁদের উপর ঈমান আনা এবং তাঁদের উপর সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। 


টীকা-১৪৩ঃ হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর যমানা থেকে হযররত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর যমানা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) তাশরীফ আনয়ন করতে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা চার হাজার বলে বর্ণিত হয়েছে। এ মহা সম্মানিত নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) হযরত মূসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর শরীয়তের রক্ষক এবং তাঁরই বিধি-নিষেধ বাস্তাবায়নকারী ছিলেন। যেহেতু, শেষ নাবী (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর পর নাবূয়্যাত কেউ পেতে পারে না, সেহেতু ‘শরীয়তে মুহাম্মদী’ বা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর শরীয়তের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচার-প্রসাররূপী খিদমতের ভার ‘ওলামা-ই-রব্বানী’ (আল্লাহ্ ওয়ালা হাক্কানী আলিমগণ) এবং ‘মুজাদ্দিদীন-ই-মিল্লাত’ (দ্বীনের সংস্কারকগণ) এর উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। 


টীকা-১৪৪ঃ এসব নিদর্শন বলতে হযরত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর মু’জিযাসমূহকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন- মৃতকে জীবিত করা, অন্ধ এবং কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা, পাখি তৈরি করা এবং অদৃশ্য বস্তু বা বিষয়াদির সংবাদ দেয়া ইত্যাদি। 


টীকা-১৪৫ঃ ‘রুহুল ক্বুদুস’ বা ‘পবিত্র আত্মা’ বলতে হযরত জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) কেই বুঝায়। কারণ, তিনি হলে রূহানী বা আত্মিক সত্তা; যিনি ওহী আনেন, যাঁর দ্বারা হৃদয়সমূহে জীবন সঞ্চারিত হয়। তিনি হযরত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর সঙ্গে আদিষ্ট ছিলেন। তাঁকে (হযরত ঈসা عَلَیۡهِ السَّلَام) তেত্রিশ বছরের পবিত্র বয়সে আসমানের উপর উঠিয়ে নেয়া হয়। এ সময় পর্যন্ত হযরত জিব্রাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) হযরত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর সফর ও ঘরে অবস্থানকালে- কখনো তাঁর নিকট থেকে পৃথক হননি। এ ‘রূহুল ক্বুদুস’ বা পবিত্র আত্মার সহায়তা হযরত ঈসা (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর এক মহান ফযিলত। বিশ্বকুল সরদার হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর ওসীলায় হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর কোন কোন উম্মতও ‘রুহুল ক্বুদুস’- এর সাহায্য লাভ করেছেন। সহীহ্ বুখারী শরীফ ইত্যাদিতে বর্ণিত আছে- হযরত হাসসান (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) এর জন্য মিম্বর বিছানো হতো। 


তিনি না’ত শরীফ পাঠ করতেন। হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم  তাঁর رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ এর জন্য দুআ’ করতেন- اَللّٰهُمَّ اَیِّدۡهُ بِرُوۡحِ الۡقُدُسِ “আল্লাহুম্মা আয়্যিদহু বিরুহিল ক্বুদুস।” (অর্থাৎ হে আল্লাহ, তাকে ‘রুহুল ক্বুদুস’- এর মাধ্যমে সাহায্য করো।)


টীকা-১৪৬ঃ এরপরও ওহে ইহুদীরা! তোমাদের অবাধ্যতার কোন রকম পরিবর্তন আসেনি। 


টীকা-১৪৭ঃ ইহুদীগণ নাবীগণ (عَلَیۡهِمُ السَّلَام) এর নির্দেশনাবলী নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পেয়ে তাঁদেরকে অস্বীকার করতো আর সুযোগ পেলে তাঁদেরকে শহীদ করে ফেলতো। যেমন, তারা হযরত শা’ইয়া ও হযরত যাকারিয়া (عَلَیۡهِمَا السَّلَام) সহ বহুসংখ্যক নাবীকে শহীদ করেছিলো। (এমনকি,) নাবীকুল সরদার হুযূর কারীম (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) কেও শহীদ করতে উদ্যত ছিলো- কখনো তাঁর উপর যাদু করেছে, কখনো খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়েছে। বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র তাঁকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে করেছে।



আয়াত নং- ৮৮

________


অনুবাদ:


৮৮ঃ এবং ইহুদীগণ বললো, ‘আমাদের হৃদয়গুলোর উপর পর্দা (আচ্ছাদন) পড়ছে’ (১৪৮); বরং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের উপর লা‘নত (অভিশাপ) করেছেন তাদের কুফরের কারণে। সুতরাং তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই ঈমান আনে (১৪৯)।

________


টীকা-১৪৮ঃ ইহুদীগণ এটা উপহাসচ্ছলে বলেছিলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো যে, হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর হিদায়ত তাদের অন্তরগুলোর পর্যন্ত পৌঁছে না। আল্লাহ্ تَعَالٰیতাদের ‘রদ্দ’ (খন্ডন) করেন- ‘তারা বে-দ্বীন, মিথ্যাবাদী।’ অন্তর গুলোকে আল্লাহ্ تَعَالٰی ‘সৃষ্টিগত স্বভাবের’ (فترت) উপর সৃষ্টি করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সত্যতা গ্রহণের যোগ্যতা রেখেছেন। তাদের কুফরের কুফল হলো- তারা নাবীকুল সরদার صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর নবুয়তকে স্বীকার করার পর অস্বীকার করেছে। আল্লাহ্ تَعَالٰی তাদের উপর লা’নত (অভিসম্পাত) করেছেন। এর প্রতিক্রিয়া এ হলো যে, সত্য গ্রহণের নি’মাত থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে।


টীকা-১৪৯ঃ এ বিষয়বস্তুটা অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- بَلۡ طَبَعَ اللّٰهُ عَلَیۡهَا بِكُفۡرِهِمۡ فَلَا یۡؤۡمِنُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا (বরং আল্লাহ্ পাক সেসব হৃদয়ের উপর তাদের কুফরের কারণেই মোহর ছেপে দিয়েছেন। কাজেই, তারা ঈমান আনবে না, কিন্তু অল্প সংখ্যক লোক’।)



আয়াত নং- ৮৯

________


অনুবাদ:


৮৯ঃ এবং যখন তাদের নিকট আল্লাহ্ তা’আলার সেই কিতাব (ক্বুরআন মাজীদ) এসেছে, যা তাদের সাথে রয়েছে এমন কিতাব (তাওরীত)- এর সত্যায়ন করে (১৫০) এবং এর পূর্বে তারা সেই নাবীর ‘ওসীলা’ ধরে কাফিরদের উপর বিজয় প্রার্থনা করতো (১৫১); অতঃপর যখন তাশরীফ এনেছেন তাদের নিকট সেই পরিচিত সত্তা, তখন তাঁকে অস্বীকারকারী হয়ে বসেছে (১৫২)। অতএব, আল্লাহর লা‘নত (অভিসম্পাত) অস্বীকারকারীদের উপর।

________


টীকা-১৫০ঃ নাবীকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর নাবূয়্যাত এবং হুযূরের গুণাবলীর বর্ণনার। (কবির ও খাযিন) 


টীকা-১৫১ঃ শানে নুযূলঃ নাবীকুল সরদার হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর নাবূয়্যাত প্রকাশ এবং ক্বুরআন কারীম নাযিল হবার পূর্বে ইহুদীগণ স্বীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর পবিত্র নামের ওসীলা ধরে প্রার্থনা করতো এবং কামিয়াব হতো। আর তারা এভাবে দুআ’ করতো-   اَللّٰهُمَّ افۡتَحۡ عَلَیۡنَا وَانۡصُرۡنَا بِا لنَّبِیِّ الۡاُمِّیِّ অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ‘নাবী-ই-উম্মী’ (আসলী নাবী) এর ওসীলায় বিজয় ও সাহায্য দান করো।” 


মাসআলাঃ এতে বুঝা গেলো যে, আল্লাহর মাকবুল বান্দাদের ওসীলায় দুআ’ প্রার্থনা কবূল হয়। একথাও বুঝা গেলো যে, হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর তাশরীফ আনয়নের পূর্বেও পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাবের প্রসিদ্ধি ছিলো। তখনও হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর ওসীলায় সৃষ্টির প্রয়োজন মিটতো।


টীকা-১৫২ঃ এ অস্বীকার গোঁড়ামী, বিদ্বেষ এবং নেতৃত্ব-লোভের কারণেই ছিলো।



আয়াত নং- ৯০

________


অনুবাদ:


৯০ঃ কতই নিকৃষ্ট বিনিময়ে তারা আপন আত্মাগুলোকে খরিদ করেছে! (তা’হলো) আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবকে (তারা) অস্বীকার করেছে (১৫৩) এ ঈর্ষায় যে, আল্লাহ্ আপন অনুগ্রহে স্বীয় যে বন্দার উপর ইচ্ছা করেন ‘ওহী’ নাযিল করেন (১৫৪)। সুতরাং (তারা) ক্রোধের উপর ক্রোধের উপযোগী হয়েছে (১৫৫)। আর কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনার শাস্তি রয়েছে (১৫৬)।

________


টীকা-১৫৩ঃ অর্থাৎ মানুষকে তার আত্মার মুক্তির জন্য তাই করা উচিত যা দ্বারা তার মুক্তির আশা করা যায়। ইহুদীগণ এ মন্দ ব্যবসা করেছে যে, আল্লাহরনাবী এবং তাঁর কিতাবকে অস্বীকার করেছে।


টীকা-১৫৪ঃ ইহুদীদের কামনা ছিলো যে, ‘খতমে নবূয়ত’ - এর পদবী বানী ইস্রাঈলের সম্প্রদায়ের কারো ভাগ্যে জুটুক।’ যখন দেখলো যে, তারা (তা থেকে) বঞ্চিত হয়েছে, ইসমাঈল (عَلَیۡهِ السَّلَام) এর বংশধরকেই (তা) দান করা হয়েছে, তখন হিংসার বশবর্তী হয়ে অস্বীকার করে বসেছে।


মাসআলাঃ এ থেকে বুঝা গেলো যে, হিংসা-বিদ্বেষ হারাম এবং বঞ্চিত হবার কারণ।


টীকা-১৫৫ঃ অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকারের গযবের উপযোগী হয়েছে। 


টীকা-১৫৬ঃ এতে বুঝা গেলো যে, লাঞ্ছনা ও অবমাননাকর আযাব কাফিরদের জন্য নির্দিষ্ট। মু’মিনদেরকে তাদের গুনাহর কারণে শাস্তি দেয়া হলেও তা লাঞ্ছনা ও অবমাননা সহকারে হবে না। আল্লাহ্ تَعَالٰی ইরশাদ করেন- وَلِلّٰهِ الۡعِزَّةُ وَلِرَسُوۡلِهٖ وَلِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ“প্রকৃত সম্মান আল্লাহরই জন্য, তাঁর রসূল (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم)- এর জন্য এবং মু’মিনদের জন্য।”



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ